ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জয় বাংলা

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ১৩ মার্চ ২০২০

জয় বাংলা

মহিমান্বিত ও অগ্নিঝরা মার্চের সময়গুলো ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্বিচার নির্যাতন আর হত্যার জঘন্য আখ্যান। আবার এই মার্চই অহঙ্কার আর গৌরবের এক আশ্চর্য বিজয়গাথা। মাসের শুরুতেই ৭ মার্চের সেই অভাবনীয় ভাষণ যা মুক্তিযুদ্ধকে এক আবশ্যকীয় দায়বদ্ধতায় সর্ববাঙালীর দ্বারে পৌঁছে দেয়। যে বক্তৃতা এখন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়, বরং তা বিশ্ব পরিসীমার এক অনন্য ঐতিহ্য। এই ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’কে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আর অন্তর্নিহিতবোধে রূপ দিয়ে জাতীয় সত্তার মর্যাদা দিয়েছিলেন। সেই থেকে ‘জয় বাংলা’ সেøাগানটি বাঙালী জাতির এক গৌরবময় আর অবিস্মরণীয় পরম সেøষাতে। এই অমেয় শব্দস্ফুলিঙ্গ কিনা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্ষণকে উজ্জীবিত করেছে। স্বাধীন মাতৃভূমির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা’ সেøাগানটি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিক মনোবলের এক আকাক্সিক্ষত জয়ধ্বনি ছিল। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি, সময় এবং ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রাক্কালে এই জয়বাংলাই অগণিত মুক্তিসেনাকে এক ও অবিচ্ছিন্ন কাতারে নিয়ে আসা ছাড়াও দেশপ্রেমের উদ্দীপ্ত চেতনায়ও অনুক্ষণ অনুরণিত হতো। কিন্তু এমন মাঙ্গলিক ও আকাক্সিক্ষত সমৃদ্ধ বার্তাটি ৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর সহিংস হত্যাকা-ের পর একেবারে বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায়বদ্ধতায় সেই ‘জয় বাংলা’ আবার স্বমহিমায় আপন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এবার শুধু দেশপ্রেমিক বাঙালীর আন্তরিক প্রতিধ্বনিতেই নয়, তার চেয়ে বেশি আইনী সুরক্ষায় তাকে সর্বজনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে নির্দেশ জারি করা হলো। নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় সেøাগান হিসেবে ঘোষণা দিতে ২০১৭ সালে রিট করেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী বশির আহমেদ। প্রাথমিক শুনানির পর একই সালের ৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে। তাতে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় সেøাগান কেন ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ, আইন ও শিক্ষা সচিবত্রয়কে এই রুলের জবাব দিতেও বলা হয়। পর্যবেক্ষণ, বিচার-বিশ্লেষণ, নির্দেশনাসহ এই রুলের নিষ্পত্তি হলে ১০ মার্চ হাইকোর্ট আদেশ জারি করে। বলা হয় আদালতের এখতিয়ারভুক্ত এমন জাতীয় দাবি সর্বসম্মতভাবে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। বাংলায় রায় ঘোষণা করে বলা হয়- মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই ‘জয় বাংলা’ সেøাগান সমগ্র দেশ ও জাতিকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি সংগ্রামী অভিযাত্রায় এই ‘জয় বাংলা’ই ছিল জয়ধ্বনি, রণহুঙ্কার। যার অন্তর্নিহিতবোধে জেগে ওঠে বাঙালিত্বের বিজয় নিশান। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়Ñ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাদের অনেকেই এই সেøাগানটি উচ্চারণ করলেও কিছু ব্যক্তি তা থেকে বিরত থাকেন। এটা আর করা যাবে না। জাতীয় সেøাগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেয়া এখন আইনীবিধি। রাষ্ট্রীয় ও সরকারী গুরুত্বপূর্ণ দিন, অনুষ্ঠান, উৎসবসহ বিভিন্ন আয়োজনে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’কে সম্মান জানাতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু কিংবা শেষেও ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ সংশ্লিষ্টদের সচেতন দায়বদ্ধতা ছাড়াও আইনী নির্দেশ। দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সেøাগানই ছিল বিশেষ জয়ধ্বনি। যেখানে ‘জয় বাংলা’ ধর্মনিরপেক্ষ সেøাগান হিসেবে সর্ববাঙালীকে আলোড়িত ও তেজোদ্দীপ্ত করতে মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনায় আসত। মুক্তিযোদ্ধারা শুধু যুদ্ধের দামামায় এমন হুঙ্কারটি দিতেন না, বরং পাকিস্তানী সামরিক জঙ্গীদের সামনেও নির্ভীক আর অহঙ্কারবোধে বীরত্বের সঙ্গে এই জয়ধ্বনি করতে ভয় পেতেন না। বিলম্বে হলেও মুক্তিকামী বাঙালীর প্রাণের উচ্চারণ ‘জয় বাংলা’ আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। এটি জাতির পরম অর্জন। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে যাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত ভয়ে সেইসব স্বাধীনতাবিরোধীর বিষয়টি যে ভাল লাগবে না সেটি জানা কথাই।
×