স্টাফ রিপোর্টার ॥ সময়মতো চিকিৎসা দিতে না পারার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫৯% হয় অসংক্রামক রোগে। আর অসংক্রামক রোগে যত মানুষ আক্রান্ত হয় ও মারা যায় তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম। নীরব ঘাতক সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু একজন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হন তা নয়, তার সঙ্গে পুরো পরিবারটিও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দুর্ঘটনার পরপরই যদি আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক সেবা দেয়া হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ ও মৃতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। উন্নত দেশে দুর্ঘটনায় এত মানুষ মারা যায় না এজন্য সবার সচেতনতা জরুরী বলে মনে করছেন বক্তারা।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে ট্রমালিঙ্ক আয়োজিত ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক সেবা প্রদানধর্মী স্বেচ্ছাসেবীমূলক কার্যক্রমের পাঁচ বছর’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে সকালের উদ্বোধনী অধিবেশনে ট্রমালিঙ্কের বিগত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়। ট্রমালিঙ্কের চেয়ারম্যান মৃদুল চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা) এ. ই. মোঃ মহিউদ্দীন ওসমানী, বিআরটিএর প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম, ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার (ট্রাফিক, দক্ষিণ) বাসুদেব বণিক, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রেজাউল আলম, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেসনাল অফিসার (এনডিসি) ডাঃ সৈয়দ মাহফুজুল হক। ট্রমালিঙ্কের ম্যানেজিং ট্রাস্টি বিধান চন্দ্র পালের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন ট্রমালিঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ড. জন মুসালেহ্। ট্রমালিঙ্কের ৫ বছরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ট্রমালিঙ্কের কার্যক্রম বিভাগের পরিচালক অরূপ সাহা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রাস্তায় যে পরিমাণ গাড়ি সেই অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। দুর্ঘটনার জন্য এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। হাছান মামুদ আরও বলেন, অনেক সময় হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সাধুবাদ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রতিটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ট্রাফিক আইন কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার জন্য বিএনপি মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছে বলেও জানান তথ্যমন্ত্রী। এ সময় বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বেগম জিয়ার মুক্তি দেয়ার এখতিয়ার সরকারের নেই। এটা আদালতের বিষয়। কারণ তিনি দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে সাজা ভোগ করছেন।
তাকে মুক্ত করার একমাত্র পথ হচ্ছে আইনী পথ। তাকে যদি আদালত জামিন দেয় তবে তিনি মুক্তি পেতে পারেন। বিএনপি বিশৃঙ্খলা করার জন্য সমাবেশের ডাক দিলে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খতিয়ে দেখবে। গণমাধ্যমের কাছে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের ফল নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ফতোয়া দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে গৎবাঁধা কথাগুলো বলা বাদ দিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নিন। শুধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নন, ঐক্যফ্রন্টের কিছু নেতাও বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনও নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলেছেন। বাংলাদেশ কোন বিষয় নিয়ে মাওলানারা যেভাবে ফতোয়া দেন, আমি লক্ষ্য করেছি ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সেভাবে ফতোয়া দেয়া শুরু করেছেন। নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। আইন বাস্তবায়ন না হলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সে পরিমাণ মানুষ মারা যায় না। দুর্ঘটনা এড়াতে পথচারী ও চালকদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি । দুর্ঘটনা এড়াতে ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সড়কে চলাচলরত অন্য গাড়ির মালিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় সড়কেই পড়ে থাকেন। আহত ব্যক্তির রক্ত গাড়িতে লেগে যাবে বলে সড়কে চলাচলরত অন্য গাড়ির মালিকরা তাদের নিজেদের গাড়িতে তুলে নিতে চান না। তাদের কাছে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির জীবনের চেয়ে গাড়ির মূল্য অনেক বেশি।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষগুলোকে চিকিৎসা দিয়ে আমরা বাঁচাতে পারতাম। তবে দুঃখজনক ও মর্মান্তিক বিষয় হলো, তাদের সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে মানুষগুলোর মৃত্যু হচ্ছে। ইলিয়াস কাঞ্চন নিজের স্ত্রীর দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার স্ত্রী যখন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন, তখন একই অবস্থা হয়েছিল। তাকে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। সেই রাজবাড়িতে, সেখানে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সে সময় এটিএম শামসুজ্জামান তার সঙ্গে ছিলেন। আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। তবে তিনিও কোন গাড়ি থামাতে পারেননি। সড়ক দুর্ঘটনায় মিশুক-মুনীরদেরও চিকিৎসা দেয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। ড. জন মুসালেহ্ স্বাগত বক্তব্যে ট্রমালিঙ্কের এই মডেলটি সারা বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং ভবিষ্যতে অন্য উন্নয়নশীল দেশের জন্যও এটি উপযোগী ভূমিকা পালন করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
উপস্থাপনায় ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কার্যক্রম শুরু বলে অরূপ সাহা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ১৩৫ কিলোমিটার এলাকায় এই কার্যক্রমটি পরিচালনা করছি। আমাদের প্রথম ৫ বছরের কার্যক্রমে আমরা ১১০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩৮৩ জন আহত ব্যক্তিকে জরুরী প্রাথমিক সেবা দান করেছি। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দুর্ঘটনা পরবর্তী সেবাদানের সাড়া দেবার হার ছিল ১০০% ও ৮৬% ক্ষেত্রে তারা দুর্ঘটনার স্থলে ৫ মিনিট বা তার কম সময়ে উপস্থিত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তের বেশিরভাগই পরিবারের জন্য উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে এ বিষয়ে একটি আলোচনা (প্যানেল ডিসকাশন) অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্বে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার-৩, এনসিডিসি ডাঃ রাইহান-ই জান্নাতের সভাপতিত্বে এবং মৃদুল চৌধুরীর সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ আসিফ রাইহান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রাক্তন পরিচালক ডাঃ খালেদা খানম, বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মিস তামান্না শারমিন এবং ট্রমালিঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের অন্যতম ড. জন মুসালেহ্।
শীর্ষ সংবাদ: