ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের তাগিদ

অপরিকল্পিত নগরায়ণে সংক্রামক, অসংক্রামক রোগ বেড়ে গেছে

প্রকাশিত: ১০:১৮, ১১ জানুয়ারি ২০২০

  অপরিকল্পিত নগরায়ণে সংক্রামক, অসংক্রামক রোগ বেড়ে গেছে

নিখিল মানখিন ॥ অপরিকল্পিত নগরায়ণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবার ওপর। একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করেও নগর স্বাস্থ্যসেবায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় তৈরি হচ্ছে না এমন অভিযোগ তুলেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নগরীতে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার বহুগুণে বেড়ে গেছে। অবাসিক এলাকা, শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে একাকার। পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। নগরমুখী মানুষের সংখ্যা চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অপ্রতুল জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে নগরবাসী। চারদিকের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সরকারী এমনকি বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে সরকারী চিকিৎসাসেবার সীমাবদ্ধতা ও অব্যবস্থাপনা। নগরস্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও আধুনিকায়নের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে নগরায়ণ। তবে দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণে জনসংখ্যার আধিক্য ও যত্রতত্র কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দালানকোঠা গড়ে ওঠার পাশাপাশি রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব, মানসিক ও স্নায়ুবিক চাপ বৃদ্ধি, সুপেয় পানির সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা, পরিবেশ ও বায়ুদূষণ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, ধূমপান ও মদ্যপানের প্রবণতা বৃদ্ধিসহ মৃত্যু, সন্ত্রাস, সড়ক দুর্ঘটনা ও আঘাত ইত্যাদি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাবে। যার পরিণতি ভোগ করতে হবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে শহরের বস্তিবাসী বা নিম্ন আয়ের মানুষের। তাই উন্নত নগর স্বাস্থ্যের জন্য উন্নত নগর পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, পৃথিবীতে ইতোমধ্যে প্রায় ৩শ’ কোটি মানুষ নগরে বসবাস করছে এবং ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সালে বিশ্বের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ শহরে অবস্থান করবে। বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের শহরে মানুষ বাড়লেও সেই তুলনায় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সুবিধা বাড়ছে ধীর গতিতে। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে নগর জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ ও অস্বাস্থ্যকর। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বিদ্যমান সমস্যা দূর করার চেষ্টা করা দরকার। অপরিকল্পিত নগরায়ণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যসেবার ওপর। অধিক জনসংখ্যার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা। নগর স্বাস্থ্যসেবায় একাধিক মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ সিটি করপোরেশনগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিটি সিটি করপোরেশনেই নগর স্বাস্থ্যসেবা দেখাশোনার একটি বিভাগ থাকে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের কর্মকান্ডের ওপরই নির্ভর করে থাকে। ইচ্ছে করলেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়াও নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পরোক্ষভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটাতে হলে এ সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, রাজধানী সচল রাখার অন্যতম কাজ হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ থেকে পিছিয়ে থাকার উপায় নেই। কারণ বর্জ্য পচনশীল, দুর্গন্ধময়, রোগ-জীবাণু সংবলিত, আবার রোগজীবাণু জন্মও দেয়। রাজধানীকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে সিটি করপোরেশন যত তৎপর হবে, জনগণকে সচেতন করতে উদ্যোগ নেবে ততই ভাল ফল বয়ে আনবে। রাজধানীতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ হলেই শিশুরা বড় হবে উন্নত চিন্তাচেতনায়, সমৃদ্ধ হবে তাদের জীবন, বেড়ে উঠবে সুস্থ সবলভাবে। হাসপাতাল বর্জ্যরে পর ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য হচ্ছে পয়ঃমল। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর মলমূত্র। পয়ঃমল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যে কারণে তাকে খোলা জায়গায় থাকতে দিতে নাই। দিলে মশা-মাছি রোগ-জীবাণু ছড়াবে। তাই নগরীর সবার জন্য নিরাপদ পায়খানা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা একান্ত কর্তব্য। এটা বস্তিবাসী বা ভাসমান লোকদের জন্য যেমন দরকার, বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের জন্যও দরকার। এই কাজটিকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই। লক্ষ করা যায়, এখনও শহরাঞ্চলের বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও ফুটপাথে যত্রতত্র মানুষ মল ত্যাগ করে। ফলে ডায়েরিয়া, আমাশয়সহ অন্যান্য রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। আর পয়ঃমল ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি বাড়িতে সেপটিক ট্যাঙ্ক, সোকওয়েল স্থাপন জরুরী বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, স্বাস্থ্যসেবার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত না হওয়ায় পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আবাসিক এলাকা,শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে একাকার। পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। নগরমুখী মানুষের সংখ্যা চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অপ্রতুল জায়গায় গাদাগাদি করে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে নগরবাসী। চারদিকের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার মোঃ সিফায়েত উল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও সিটি করপোরেশনের অধীনে নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। ওই সব কেন্দ্রগুলোতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। অনেকে না বুঝে নগরীর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় বলে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের শহর-নগরগুলোতেও জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। শহরের বস্তি এলাকায় গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অভিবাসন সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তারে প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা নিরসনে সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে শহর-নগরগুলোতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সব প্রচেষ্টার তেমন কোন অর্থবহ ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। ফলে পুরো জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
×