ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯

বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ যা বলেছেন তা অপ্রিয় হলেও সত্য। এমনিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমাবর্তন একটি আনন্দঘন উৎসব, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করে চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি অতি মূল্যবান সনদ পেয়ে থাকে, যা পরবর্তী জীবনে তাদের চাকরি-বাকরি, গবেষণা কিংবা অন্যবিধ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অবারিত সুযোগ করে দেয়। বলতেই হয় যে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি যথেষ্ট খোলামেলা ও অকপট, আন্তরিক ও বক্তব্য উপস্থাপনে হাস্যরসোজ্জ্বল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করে পারেননি। বুয়েটের মতো স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠান মেধাবী ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় একটানা বন্ধ ছিল প্রায় আড়াই মাস শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-বিক্ষোভে। সর্বাধিক যা দুঃখজনক ও মর্মান্তিক তা হলো, আবরারকে র‌্যাগিংয়ের নামে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই সহপাঠী ও রুমমেট, যাদের অধিকাংশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে সরকার প্রধানের ত্বরিত হস্তক্ষেপে খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হয় এবং আবরার হত্যাকা-ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারসহ মুখোমুখি হতে হয়েছে বিচারের। শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ইতোমধ্যেই তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে এবং নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাজনীতি। এ প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রপতি সংক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন যে, এর দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ভাইস চ্যান্সেলর এড়াতে পারেন না কিছুতেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন থেকেই তথাকথিত বড় ভাই বা সিনিয়র কর্তৃক ‘ছোট ভাই’দের র‌্যাগিংয়ের নামে অত্যাচার-নির্যাতন চলে আসছে, যা ভিসিসহ একাধিক শিক্ষক, ডিন, প্রক্টর, প্রভোস্ট, এমনকি ছাত্র কল্যাণে নিয়োজিত দায়িত্বপ্রাপ্তদের না জানার কথা নয়। দুঃখজনক হলো, র‌্যাগিং বন্ধে প্রায় কেউই কোথাও কোন ব্যবস্থা নেননি। ফলে আবরার হত্যার মতো ট্র্যাজেডি এড়ানো যায়নি। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষকম-লী দায় এড়াতে পারেন না কোন অবস্থাতেই। মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থীরা লাশ কিংবা বহিষ্কার হতে আসেন না ক্যাম্পাসে। এর বাইরেও রাষ্ট্রপতি বলেছেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দিনে সরকারী এবং রাতে বেসরকারী হয়ে যায়Ñ এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। অনেক শিক্ষকই নিয়মিত ক্লাস নেয়া ও পরীক্ষা গ্রহণে অনিচ্ছুক। অথচ রাতের বেলা তারা ইভিনিং কোর্স নিতে খুবই আগ্রহী, কেননা সেখানে নগদ উপার্জন হয়। এতে শিক্ষার্থীদের কতটা জ্ঞানার্জন হয় তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পকেট ভারি হয় এক শ্রেণীর শিক্ষকের। প্রতি বছর ভর্তি বাণিজ্যের বিষয়টিও প্রকট। ভিসিরা এ বিষয়ে অবহিত নিশ্চয়ই। এর বাইরেও ইদানীং বেশ কয়েকজন ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যা তদন্তাধীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। শিক্ষকম-লী ও শিক্ষার্থীদের দলীয় রাজনীতি, পারস্পরিক কোন্দল, অন্তর্কলহ, নীতিনৈতিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ। বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার্থীদের নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগও উঠেছে। এতে প্রতিনিয়ত অধঃপতিত হচ্ছে শিক্ষার মান, যা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রতি প্রায় বিমুখ করে তুলছে। দেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে এক নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হয়েছে সম্প্রতি। চলতি বছর এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়। অস্থির রাজনীতির কালোছায়া পড়েছে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষক রাজনীতিও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষা-বিরুদ্ধ কর্মকা- অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। দেশের ভবিষ্যত যারা, সেই শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচী সব সময় পরিত্যাজ্য। এর পাশাপাশি সমধিক গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে ঢাবি সমাবর্তনে উপস্থাপিত রাষ্ট্রপতির বক্তব্য।
×