ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

ডিসেম্বর আসছে। আগামী রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে বিজয়ের মাস। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে এ মাসেই বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী। বিরাট অর্জনের পর বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের দেশ তেমন মনে রাখেনি। মনে রাখেনি বললেই চলে। হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/বড়ো বড়ো লোকেদের ভিড়ে জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/তোমাদের কথা কেউ কবেনা/তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা/তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবেনা...। ঋণ শোধের আন্তরিক চেষ্টাও হয়নি কোনদিন। তবে ১৬ ডিসেম্বরের মতো জাতীয় দিবসে এখন তাদের কিছুটা খোঁজ খবর করা হয়। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এবারও হয়ত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ধাম নেয়া হবে। বড় বড় নেতা আর এসপি ডিসিদের চেয়ারের পাশে একটি চেয়ার হয়ত তাঁদের কারও কারও জন্য রাখা হবে। মেঠো বক্তৃতা শুনে শুনে ক্লান্ত হবেন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধারা। অবশ্য এর পাশাপাশি কিছু আন্তরিক প্রয়াসও চোখে পড়ে। পড়বে। প্রতি বছর এ সময় এক ধরনের জাগরণের সৃষ্টি হতে দেখি আমরা। দেশবোধটা যেন নতুন করে জেগে ওঠে। একই লক্ষ্য নিয়ে এবারও বিজয় দিবসের উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। সামনে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। মুজিববর্ষ। বড় দুটি উপলক্ষ সামনে রেখে ঢাকায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান সাজানো হচ্ছে। সরকারী-বেসরকারী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পাওয়া গেছে এমন আভাস। সব ঠিকঠাক থাকলে উদ্যাপনের দিক দিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ হবে বিজয় দিবস। পাশাপাশি নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দেবে, জাগিয়ে দেবে নতুন করে, সে আশাও করা হচ্ছে। এদিকে, বিজয়ের মাস শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা মামলার রায় দেয়া হলো। মঙ্গলবার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুালের বিচারক মোঃ মজিবুর রহমান এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সাত আসামিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নৃশংস জঙ্গী হামলার বিচারিক কাজের প্রথম ধাপ পার হলো। তবে মামলার রায়ে খুব কিছু যেন পাওয়ার নেই ঢাকাবাসীর। বরং এই শহরের বুক ক্ষত-বিক্ষত করা দুঃসহ স্মৃতি আবারও সবার সামনে এসেছে। রাজধানীর মানবিক মানুষেরা দিনটির কথা ভেবে মনোকষ্টে ভুগছেন এখনও। এক ধরনের অপরাধবোধ অনেকের মাঝে কাজ করেছে। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের ঘটনা এই শহরে ঘটেছিল! আজও যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর শহুরে জীবনে যে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা এতদিনে দূর হয়েছে বলেই মনে হয়। জঙ্গীবাদও আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। তবে সতর্ক করে দিয়ে তারা বলছেন, উগ্রবাদীদের এত ধরনের উত্থান টের পাওয়া যাচ্ছে। এই উত্থান ঠেকাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে হলে মৌলবাদী উগ্রবাদীদের দমন করার কোন বিকল্প নেই বলেই মনে করেন তারা। শেষ করা যাক রবিউল হুসাইনের কথা স্মরণ করে। এই শহরেরই মানুষ তিনি। দীর্ঘকাল বাস করেছেন। তারপর চির বিদায়। খ্যাতিমান কবি ও স্থপতি মঙ্গলবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বুধবার সব শ্রেণী পেশার মানুষের পক্ষ থেকে তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়। একুশে পদকে ভূষিত কবি স্থপতি একইসঙ্গে বহু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি হিসেবে একাত্তরের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। শহর ঢাকায় অনেক স্মৃতিচিহ্ন তার। নিজের স্থাপত্য কর্মের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তাকে। কিন্তু মানুষটি নেই। তার থাকা না থাকা নিয়ে বুধবার শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে কথা হচ্ছিল বিশিষ্টজনের সঙ্গে। দীর্ঘকালের পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলছিলেন, ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে আমি যখন সদ্য কৈশর উত্তীর্ণ যুবক তখন কবি রবিউল হুসাইনের সঙ্গে পরিচয়। তারপর অর্ধ শতাব্দী অতিক্রম করেছে আমাদের বন্ধুত্ব। যে ক’জন বিরল ভাল মানুষের সাক্ষাত এ জীবনে পেয়েছি তার মধ্যে রবিউল ভাই শ্রেষ্ঠতম। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের আমরা যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছি তারা ভাগ্যবান। রবিউল হুসাইনের বন্ধু বরেণ্য শিল্পী মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, রবিউল যেখানে যেত সেখানেই একটা শান্তির ছায়া যেন নেমে আসত। সবাইকে এক করতে পারত সে। কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করত না। রবিউল হুসাইনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন আরেক কবি তারিক সুজাত। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি রবিউল হুসাইনের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তিনি বলছিলেন, শিল্পের নানা মাধ্যমের সঙ্গে একটা সেতুবন্ধ স্থাপন করেছিলেন রবিউল ভাই। কেউ শুধু কবিতা জানবে, সঙ্গীত নয়। চলচ্চিত্র বুঝবে, থিয়েটার নয়। না, এমনটি রবিউল ভাইয়ের বেলায় দেখা যায়নি। বহু প্রতিভা নিজের মধ্যে লালন করেছেন তিনি। কিন্তু কোন ধরনের প্রচার নেননি। আড়ালে থেকে, নীরবে নিভৃতে থেকেও যে বড় কাজ করা যায়, তার বিরল উদাহরণ রবিউল হুসাইন।
×