ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ॥ সৌভ্রাতৃত্বের নবজাগরণ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিল কারা?

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ৭ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ॥ সৌভ্রাতৃত্বের নবজাগরণ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিল কারা?

বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়। ১ কোটিরও বেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ নেয় এবং শেষ দিকে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় এনে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এটা সবারই প্রত্যাশা ছিল যে- দুদেশের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুটো দেশই এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শান্তির পথে। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি কর্তৃক ভারতকে বাংলাদেশের রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর আস্থার বদলে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয় অবিশ^াস আর বিশ্বাস ভঙ্গের কূটকৌশল। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী সেøাগানের আড়ালে রয়েছে কুৎসিত রাজনীতি। ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করা হলেও বাংলাদেশের দাবি-দাওয়া ভারতের কাছে উত্থাপন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তা আদায়ের প্রশ্নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ এটাই বাংলাদেশের জন্য ছিল সবচেয়ে মঙ্গলজনক। উপমহাদেশের জন্য ছিল সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ। ভারত নিয়ে এই রাজনীতির গূঢ় রহস্য বুঝতে হলে আমাদের পেছনে ফিরে দেখতে হবে। তথ্যগুলো তুলে ধরতে হবে মানুষের সামনে- ১৯৭২-৭৫ (বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল) ১৯৭২ : ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন। দিল্লীর লাখো জনতা, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ নেতৃবৃন্দ তাকে অভ্যর্থনা জানান। এখানে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তারা বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল, খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে ছিল। রণাঙ্গনে হাজার হাজার ভারতীয় প্রাণ দিয়েছে।’ তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকারও প্রশংসা করেন। তিনি ভারতকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।’ ১৯৭২ : ৬ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু মাত্র একদিনের সফরে কলকাতা যান। তিনি সেখানে এক জনসভায় ভাষণ দেন। জনসভা শেষে রাজভবনে ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হবে। ১৯৭২ : ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন। ১১ মার্চ আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ২৫ বছর মেয়াদী শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭২ : জুন, যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৪ : ১২ মে, বঙ্গবন্ধু ভারত সফর করেন। ওই সফরে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়। তিনবিঘা করিডর বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭৫ : ১৬ এপ্রিল, ঢাকায় ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে শুরু হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক। ১৮ এপ্রিল ফারাক্কা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের জন্য সুনিশ্চিত করা হয়। ১৯৭৬-৮১ (জিয়ার শাসনামল) ১৯৭৭ : ৩০ এপ্রিল, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি দেশ পরিচালনায় ভারতের সহযোগিতা কামনা করেন। ১৯৭৭ : যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে গঙ্গার পানির হিস্যা ৪৫ হাজার কিউসেক থেকে কমিয়ে ২০ হাজার কিউসেক করা হয়। বিএম আব্বাস এটি-এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ১৯৭৮ : যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ভারত টিপাইমুখ ব্যারাজের নকশা উপস্থাপন করলে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি জানায়। ১৯৮০ : ২১ জানুয়ারি, জিয়াউর রহমান ইউনিডোর সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে যান। জনপ্রিয় দৈনিক হিন্দুর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘ফারাক্কা বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু বলার নেই।’ বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গে জিয়া বলেন, ‘ভারত বড় দেশ, তাই বাণিজ্য ঘাটতি স্বাভাবিক ঘটনা।’ ১৯৯১-৯৬ (বেগম জিয়ার শাসনামল) ১৯৯১ : বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাংক সমীক্ষণ প্রতিবেদন FAP-১, বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে সিলেট অঞ্চলে বন্যা ঠেকাতে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা সমর্থন করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদের সপ্তম বৈঠকে অনুমোদিত হয়। ১৯৯২ : ভারত সফরে যান তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। এই সফরের যৌথ ঘোষণায় ভারতের পণ্য সরবরাহ সুবিধা দিতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়। ১৯৯৩ : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিনদিনের সফরে ভারত যান। সেখানে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ফারাক্কা, তিস্তা এবং অমীমাংসিত সীমানা প্রশ্নে কোন আলোচনা হয়নি। দেশে ফিরে ফারাক্কা প্রশ্নে কোন আলোচনা হয়েছে কি-না- সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রসঙ্গটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’ ২০০১-২০০৬ (বেগম জিয়ার শাসনামল) ২০০১ : আগস্ট, নির্বাচনের আগে উচ্চ পর্যায়ের একটি বিএনপি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। ২৬ আগস্ট, টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, বিএনপির নেতা রিয়াজ রহমান জানিয়েছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতে গ্যাস রফতানি করবে। বাংলাদেশে ভারতের পণ্য উন্মুক্ত করা হবে এবং সব ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হবে। ২০০২ : ফেব্রুয়ারি, যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিকে কার্যকর করার প্রস্তাব দেয়। বেগম জিয়া সরকারের পানি সম্পদমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ‘এই চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে।’ ২০০৩ : মার্চ, ভারত অভিযোগ করে, বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এর কোন প্রতিবাদ করেনি। ২০০৩ : এপ্রিল, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারত থেকে জঙ্গীরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। সেখানে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ জঙ্গীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ২০০৪ : জানুয়ারি, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করে লস্কর-ই-তৈয়বাসহ বেশ কিছু জঙ্গী সংগঠন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। ২০০৫ : অক্টোবর, উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফের বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়। এই রিপোর্ট পররাষ্ট্র দফতরে পাঠানো হলেও এ ব্যাপারে ঢাকা কোন প্রতিবাদ করেনি। ২০০৫ : ডিসেম্বর, নিরাপত্তার কারণে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। ২০০৬ : ২০ মার্চ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া তিনদিনের ভারত সফরে যান। এই সফরে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি কোন প্রসঙ্গ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়নি। ১৯৯৬-২০০১ (আওয়ামী লীগ শাসনামল) ১৯৯৬ : ১২ ডিসেম্বর, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে দীর্ঘ ২২ বছর পর বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পায়। বিএনপি ঘোষণা করে ক্ষমতায় এলে তারা এই চুক্তি বাতিল করবে। ১৯৯৪ : বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আরও ১০৫টি পণ্য ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। ১৯৯৭ : পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে পাহাড়ীরা দেশে ফেরে। শান্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বিএনপি আবারও ঘোষণা করে, ক্ষমতায় গেলে তারা পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাতিল করবে। ১৯৯৮ : বাংলাদেশ-ভারত দু’-দেশ সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়ার ঘোষণা দেয়। ২০০০ : অমীমাংসিত সীমানা নির্ধারণে যৌথ কমিটি আলোচনা শুরু করে। ২০০৯-২০১৪ (আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়) ২০০৯ : সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানান। ২০০৯ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফর করেন। ভারত সফরে দুই দেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয় সমাধানের যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়। ২০০৯ : ১১ জানুয়ারি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক ভারত সফর। ৫০-দফা যৌথ ঘোষণার উল্লেখযোগ্য বিষয় হলোÑ * বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে একে অন্যের সমুদ্র, রেল ও সড়ক পথ ব্যবহারে দু’দেশের সম্মতি। নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের সীমান্ত ব্যবহারের সুযোগ। * বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেবে। একই সঙ্গে এই দুই বন্দর নেপাল ও ভুটানকেও ব্যবহার করতে দেয়া হবে। * আশুগঞ্জ ও শিলাঘাটকে পোর্ট অব কল দিতে রাজি হয়েছে দুই দেশ। * বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থা সংস্কার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নদী পুনর্খননের জন্য ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে ভারত। * বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু টিপাইমুখ প্রকল্পে করা হবে না। * তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে দুই দেশের পানি সম্পদমন্ত্রীরা আগামী মার্চের মধ্যে বৈঠক করবেন। * ভারত ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত দেবে বাংলাদেশকে। * সন্ত্রাসবাদ দমন ও গণতন্ত্রের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মর্যাদাপূর্ণ ‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক’-এ ভূষিত। * জাতিসংঘের সমুদ্রসীমানা আইন অনুযায়ী দুই দেশের সমুদ্রসীমা পুনর্নির্ধারণে উভয় দেশ সম্মত হয়। * ভারতে ৩০০ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর বৃত্তি দিতে ভারত সরকার সম্মত হয়। * ২০১১-১২-তে নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যপদ লাভে ভারত বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে। * অপরাধ দমন বিষয়ে পরস্পরকে আইনী সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। * সাজাপ্রাপ্ত বন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। * আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ এবং অবৈধ মাদক পাচার মোকাবেলায় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৫-বর্তমান (আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়) ২০১৫: ৭ মে, ভারতীয় সংসদ সর্বসম্মতভাবে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমানা চুক্তি অনুমোদন করে, যা ভারতীয় সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী। এর ফলে দুই দেশের সীমানা নিয়ে ৬৮ বছরের বিবাদ শেষ হয়। ২০১৫ : জুন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফর করেন এবং দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০ কোটি ডলারের ঋণ বিষয়ক সমঝোতা হয়, ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৫ : ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ১৬২ ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৫০ হাজার বিচ্ছিন্ন নাগরিক, যাদের কোন জাতীয়তার পরিচয়ই ছিল না, তারা ভারত অথবা বাংলাদেশের নাগরিক হন। এই বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে, এই বিনিময় ছিটমহলের বাসিন্দাদের সুযোগ করে দেয়, যারা যে দেশের ভেতরে আছে, সেই দেশেই থাকতে পারেন অথবা চাইলে পাশের দেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারেন। ভারতে ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দার সংখ্যা ছিল ১৪,২১৪ জন। যাদের সবাই ভারতেই থেকে যায় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে। আর বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের প্রায় ৪১ হাজার অধিবাসীর অধিকাংশ বাংলাদেশেই থেকে যায়, শুধু ৯৭৯ জন ভারতে স্থানান্তরিত হয়। ২০১৭ : এপ্রিল, শেখ হাসিনার নয়াদিল্লীতে চারদিনের সফরে বাংলাদেশ-ভারত দুটি সামরিক চুক্তি সই করে। ভারতের সঙ্গে ভিন্ন কোন দেশের সামরিক চুক্তি এটিই প্রথম ছিল। এই চুক্তি অনুসারে দুই দেশই যুগ্মভাবে অনুশীলন এবং প্রশিক্ষণ নিতে পারে। সামরিক খাতে উন্নয়নের জন্য যদি কোন সামরিক কেন্দ্র স্থাপন করতে হয়, তবে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। বাংলাদেশকে ভারত সামরিক খাতে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে। ভারত প্রথমবারের মতো সামরিক খাতে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সীমা নির্ধারণ করে দেয়। ২০১৮ : বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ নয়াদিল্লীতে আন্তর্জাতিক সৌরজোটের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে (১১ মার্চ ২০১৮) বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি গোয়াহাটি (অসম) এবং শিলং, বালাত (মেঘালয়) ভ্রমণ করেন (৮-১০ মার্চ ২০১৮); যেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবস্থান করেছিলেন। ২০১৮ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫-২৬ মে ২০১৮ পশ্চিম বাংলা সফর করেন। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তি নিকেতনে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নেন। আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডি. লিট প্রদান করে। ২০১৮ : জুলাই, ৮-১০ এপ্রিল ২০১৮ ভারতীয় বিদেশ সচিব বাংলাদেশ সফর করেন। পরে গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিং ১৫ জুলাই ২০১৮ বাংলাদেশ সফর করেন এবং বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে একটি সমন্বিত ও অত্যাধুনিক ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। ২০১৮ : সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১৩০ কিমি দীর্ঘ ‘ভারত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন’ উদ্বোধন করেন। সেপ্টেম্বর ২০১৮তে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা এ সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়া অনুমোদন করে, যার ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ভারত পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। ২০১৯ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে চারদিনের সরকারী সফরে নয়াদিল্লী অবস্থান করছেন। সফরের প্রথম দুই দিনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম আয়োজিত ‘ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিট’-এ যোগ দেন। সফরের শেষ দুই দিন শেখ হাসিনা দ্বিপাক্ষিক সফর। এ ছাড়া রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঐতিহাসিক হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×