ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ১১:০২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৩তম জন্মবার্ষিকীর সুবর্ণদ্বারে। গত দশ বছরে দেশের সাফল্যের যে বিজয়গাথা সেখানে শুধু দেশ ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নই হয়নি, তার চেয়েও বেশি নিজেকে তুলে ধরেছেন বিশ্বের অনন্য উচ্চতায়। জন্মবর্ষে তেমন সব অবিস্মরণীয় যোগসাজশে শেখ হাসিনার যে আলোকিত জীবন, সেখানে বিপত্তি এবং দুঃসহ অভিযাত্রার ক্রান্তিকালও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী নয় মাসের অবর্ণনীয় দুর্দশা থেকে ’৭৫ পরবর্তী বিপন্ন বাংলাদেশের হরেকরকম বিপর্যয়ের শিকার হওয়া প্রধানমন্ত্রীর যাপিত জীবন কোনভাবেই সুস্থির, স্বস্তিদায়ক কিংবা নিঃসংশয় ছিল না। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকা-ের মতো বীভৎস অবস্থার মোকাবেলা করাও জীবনের এক শঙ্কিত দুঃসময়। শুধু কি পিতার মর্মস্পশী চলে যাওয়া? মা, তিন ভাই ও দুই ভ্রাতৃবধূর নৃশংস হত্যাকা-ে দুঃসহ নিঃসঙ্গতা প্রতিদিনের সাক্ষী থেকেছে। কত জন্মদিন নীরবে-নিঃশব্দে অশ্রুসিক্ত বেদনায় অন্তরের নিভৃতে দুঃখের অনুরণন তৈরি করে তেমন ঘটনাও জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে তাড়িত করেছে। তিরিশের কোঠা পার হওয়ার আগেই পিতা-মাতা, ভাই-বোন ছাড়া জন্মোৎসবকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে দিয়েছে। তেমন মনোকষ্ট তো একাবারে নিজের, হৃদয় নিভৃতের এক জ্বালাময় অনুভব। সেই দুঃসময় পার হওয়াও নির্বিঘœ আর নিরাপদ ছিল না। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মাটিতেই পা রাখতে পারেননি। ভারতের নয়াদিল্লীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সস্নেহ অভিভাবকত্বে কাটিয়ে দিতে হয়েছিল। পর্বত প্রমাণ দায় মাথায় নিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে মাতৃভূমির আঙ্গিনায় পা রাখেন। ভেতরে দৃঢ় শপথ ধারণ করে বাইরে শত্রু পরিবেষ্টিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধ অপশক্তির প্রচ- দাপট খুব বেশি তোয়াক্কা করেননি। সহিংস জিঘাংসায় কোন পশু কিংবা অশুভ শক্তিকে লালন করা ছাড়াই সুস্থ, স্বাভাবিক অন্তর্নিহিত বোধকে শান্ত আর দৃঢ়তায় দিনের পর দিন শাণিত করেছেন। অসংহত এই ঐতিহাসিক সংগঠনকে নিজের বলিষ্ঠ চেতনা আর অকৃত্রিম দেশাত্মবোধে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় অব্যাহত কর্ম প্রক্রিয়ায় এগিয়ে গেছেন। তৎকালীন সময় দেশের যে অদম্য অস্থিরতা, রাষ্ট্রনৈতিক অরাজকতা, মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তির পশ্চাদগামিতা, সব মিলিয়ে হাসিনা যে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করলেন, সেটা মূলত এক বিপথগামী, বিশৃঙ্খল, ক্ষমতালিপ্সুদের ন্যক্কারজনক অপতৎপরতা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তখন যোজন যোজন দূরে। চারপাশের অপ্রতিরোধ্য বেড়াজাল চক্রব্যুহের মতো এমন আটকানো ছিল যে, বের হওয়াও যেখানে অসম্ভবের পর্যায়। সেই অবর্ণনীয় চক্রান্ত থেকে ঠা-া মাথায়, দৃঢ় মনোবল আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় অবিচ্ছিন্ন হওয়ার সেই অসম সাহস তাও জীবনের এক অবিস্মরণী পালাক্রম। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন তার পথপরিক্রমায় নেতৃত্বের সঙ্কটকে মোকাবেলা করাও সেই বিপর্যস্ত সময়ের ক্রান্তিকাল। সেখান থেকে নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে দলকে নিয়ে যে অনন্য যাত্রাপথ তাও সংগঠনটির ইতিহাসে এক বিশিষ্ট মাইলফলক। অতীতের ক্ষতবিক্ষত যন্ত্রণা অন্তরে কঠিনভাবে ধারণ করে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে। নিজেকে নতুন অবয়বে এগিয়ে নিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করেছেন। পাশাপাশি প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে আত্মস্বীকৃত খুনীরা চরম উল্লাসে সারাদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকে পুরস্কৃত হয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে। আর শেখ হাসিনার জীবন চলতে থাকে অন্য রকম এক বাঁকে। যশস্বী পিতার স্নেহের আধার এক প্রিয় কন্যার নিয়মিত পথচলার লড়াকু জীবনের দুর্গম আর বিপন্ন অবস্থাকে পাড়ি দেয়া। অসহায়. রিক্ত, নিঃস্ব অবস্থায় নিজ দেশে আসার পর থেকেই আজ অবধি দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় প্রতিনিয়তই এগিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক বছরের প্রবাস জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে পেছনে ফেলে বাংলার গণমানুষের কাতারে যখন সম্পৃক্ত হলেন, তেমন যাত্রাপথও কখনও নিরাপদ আর নির্বিঘœ ছিল না। তার পরেও পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়াই নয় জাতির জনকের নির্মম হত্যাকা-ের বিচার করা থেকে শুরু করে মানবতাবিরোধী অপরাধী ’৭১-এর ঘাতক দালালদের আসামির কাঠগড়য় দাঁড় করানোও তার অবিস্মরণীয় কীর্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হরণকারী অপশক্তির শাস্তির রায়কে কার্যকর করে মুক্তিযুদ্ধের পরিশুদ্ধ বোধের নিরবচ্ছিন্ন দায়বদ্ধতা প্রতিনিয়তই প্রমাণ করে যাচ্ছেন। আরও বহুদিন বাংলাদেশের হাল ধরতে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের প্রতি আস্থাভাজন ১৬ কোটি মানুষের অন্তর নিঃসৃত শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর অভিনন্দন। সুস্বাস্থ্য আর নির্বিঘœ জীবন সামনে চলার পথকে অবারিত করে তাঁর নিজের এবং দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধন হবে এমন কামনা বিশ্ব প্রতিপালকের প্রতি সুস্থ ও সাবলীলভাবে এগিয়ে যাবার ধারায়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দীর্ঘ জীবন নিষ্কণ্টক হোক তেমন প্রত্যাশা সাধারণ জনগোষ্ঠীর। ১৯৮১ সাল থেকে দেশের পবিত্র মাটিতে পা রেখে যে অবিচল দেশাত্মবোধ আর সংগ্রামী অভিযাত্রায় নিজেকে উজাড় করে দিলেন আজ অবধি সেটাই প্রতিদিনের জীবন এবং কর্মপ্রবাহের দৃঢ় ও প্রত্যয়ী এগিয়ে চলা। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কষ্টকর ও নিভৃত সময়গুলোকে অদম্য মনোবলে পেছনে ফেলে বাংলার গণমানুষের কাতারে যেভাবে সম্পৃক্ত হলেন, সেই অপরাজেয় নেতৃত্ব এখনও সেখান থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের লড়াইয়ে তাদের সঙ্গে সহযোদ্ধার মিছিলে পাশে থাকতে চান তিনি। পরমাণু বিজ্ঞানীর গৃহবধূ আর দুই সন্তানের জননীর যা করার কথা ছিল সেখান থেকে তিনি কোথায় চলে এলেন ভাবতে গেলেও শ্রদ্ধা আর বিস্ময় মিশ্রিত মুগ্ধতা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তায়ও আনা যায় না। ছোট্ট পরিবারের গ-ি থেকে বৃহত্তর সামাজিক আঙ্গিনায় নিজের অংশীদারিত্ব জোরদার করতে গিয়ে সাধারণ জীবন কখনও শঙ্কামুক্ত, নির্বিঘœ আর নিঃসংশয় ছিল না। হত্যার মতো জঘন্য সঙ্কট মোকাবেলা ছাড়াও কত বিপর্যয়, কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম পথ পার হতে হয়েছে গত ৩৮ বছর ধরে সেই ইতিহাসও সহজ এবং স্বাভাবিক নয়। প্রথম থেকে যে অনমনীয় ব্রতে বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যথার্থ গতি নির্ণয়, তারই লক্ষ্যমাত্রায় নিজেকে ক্রমান্বয়ে শাণিত করা। যে আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন রূপ দিতে গিয়ে দেশ আর মানুষ ছাড়া অন্য কোন কিছু ভাবতেও চাননি। নিরবচ্ছিন্ন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে যাওয়ার পথকে সমন্বিত আর সাবলীল করেছেন। জনগণ সর্ববিধ ক্ষমতার উৎসই শুধু নয়, অতন্দ্র প্রহরীর মতো দেশকে সুরক্ষিত রাখতে নিয়ামক শক্তিও বটে। সবার আগে প্রয়োজন পড়ে পিতার হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে তার ঐতিহ্যিক ও মূল চেতনায় সংহত ও সংগঠিত করার। যে দল মুক্তিযুদ্ধের মতো দীর্ঘ সংগ্রামী পথযাত্রায় একক নেতৃত্বে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেই সংগ্রামী দলকে নতুন করে পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে আরও দীর্ঘ এক লড়াইয়ের যাত্রাপথকে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন করার মহান প্রত্যয়ে এগিয়ে যান। কোন বিশৃঙ্খল কিংবা অপরিণামদর্শী কার্যক্রমকে কখনও আমলে নেননি। সময়টা ছিল স্বৈরাচারী এরশাদ আমলের সামরিক বিভীষিকায় পথহারা এক সংগ্রামী জাতির সঙ্কটাপন্ন সামাজিক অস্থিরতা। তেমন রাজনৈতিক সাংঘর্ষিক অবস্থান থেকে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধারায় এগিয়ে যেতে সাধারণ মানুষকে আরও অপেক্ষা করতে হয়েছিল। নেতৃত্ব শূন্যতায় দলের বিপর্যয়কেও শক্ত হাতে সামলাতে হয়। আশির দশকের ঘটনা পরম্পরায় নিজেকেসহ দলকে নিয়ে যে নতুন যাত্রার নিশানা স্থির করলেন সেটাও কত দুর্গম আর অনধিগম্য ছিল, সেটিও সবার জানা। দলের সঙ্গে দেশ ও মানুষকে এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আর চেতনায় চালিত করতে সব ধরনের ঝুঁকিকে সম্মুখ সমরে সামলাতে হয়েছে। জীবননাশের মতো বাধা-বিপত্তিকেও এড়ানো সম্ভব হয়নি। এরশাদের আমলে নির্বাচনে অংশ নিতেও ছিলেন দ্বিধাহীন। কারণ প্রতিনিয়তই চর্চা ছিল সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারাকে বেগবান করা। তবে জনগণের সমর্থন ও আস্থা পেতে তাঁকে আরও অপেক্ষমাণ থাকতে হয়। এক বিভ্রান্ত ও বিপন্ন জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে সম্পৃক্ত করতে সেই ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতাও প্রমাণ করেছেন। প্রথমেই নিজেকে শক্তিশালী বিরোধী দলের কাতারে শামিল করতে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক সুষ্ঠু ধারায় জনগণের রায়কে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে গঠনমূলক সমালোচনা করে দেশ ও জাতির কল্যাণে যা যা করার বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে সে সবও করতে বিন্দুমাত্র ভাবতে হয়নি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায় পেয়ে সরকার গঠন, সেও বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বিরাট বিজয় স্তম্ভ। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশকে নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করে জাতির পিতাকে যথার্থ স্থানে অভিষিক্ত করাÑ সেও যেন ইতিাহসের এক মহান কর্তব্য সম্পাদন। সময়ের প্রজন্মের কাছে শ্রেষ্ঠ বাঙালীর ইতিবৃত্ত অপসৃয়মাণ। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে প্রায়ই বিচ্ছিন্ন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি দাপটের সঙ্গে দেশের পবিত্র ভূমি কলঙ্কিত করে যাচ্ছে। সেখান থেকে জাতিকে পুনরায় নবোদ্যমে জাগিয়ে তোলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৃহত্তর অর্জন। তার পরেও পাঁচ বছরে সব ধরনের অভিশাপ, আবর্জনা ও কলঙ্ক মোচন অসম্ভব ছিল। ফলে মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় নতুন ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের আবর্তে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সেই দুঃশাসনও শেখ হাসিনার জীবনকে গ্রেনেড বিধ্বংসী রক্তপ্লাবনে ভাসিয়ে দিতে চাইলেও তিনি আবারও সুরক্ষা পেয়ে যান সৌভাগ্যের মঙ্গল ছায়ায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও অনেক বিপরীত স্রোতকে সামলে পুনরায় জনগণের রায় তাঁর পক্ষে গেলে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে দশ বছর ধরে সুদৃঢ় শক্ত অবস্থান দেশে-বিদেশে আলোড়িত আর আলোচিত হয়ে বিশ্বসভায় প্রিয় মাতৃভূমিকে আপন স্বকীয়তাকে সমুন্নত করেছেন। লেখক : সাংবাদিক
×