ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাইপ লাইন নির্মাণ শেষ হয়নি, বসে কাটাচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল

প্রকাশিত: ১০:১২, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 পাইপ লাইন নির্মাণ শেষ হয়নি, বসে কাটাচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল

রশিদ মামুন ॥ গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ না হওয়াতে বসেই কাটাতে হচ্ছে একটি এলএনজি টার্মিনালকে। বসে কাটালেও চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া ঠিকই মেটাতে হচ্ছে। আর সেই ভাড়া অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ব্যয় হওয়া অর্থের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার মতো। বিশাল এই অঙ্কের টাকাকে বড় ধরনের গচ্চা বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপ লাইন নির্মাণ শেষ হবে কি না তা না বুঝেই কাজ দেয়ায় এই আর্থিক ক্ষতি মেনে নিতে হচ্ছে। দেশে দুটি এলএনজি টার্মিনাল থাকলেও একটি থেকেই গ্যাস পরিবহনের ক্ষমতা রয়েছে পাইপ লাইনের। এখন গড়ে ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো এলএনজি জাতীয় গ্রিডে দেয়া হচ্ছে। আগে একটি টার্মিনাল থাকা অবস্থায়ও সর্বোচ্চ ৫৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন যে পরিমাণ এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি গ্যাস একটি টার্মিনাল থাকা অবস্থায়ও দেয়া হয়েছে। নানা নাটকীয়তার পর গত বছর ১৮ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ এলএনজি যুগে প্রবেশ করে। দেশের ইতিহাসে এই দিনই প্রথম আমদানি করা তরলীকৃত গ্যাস পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপ লাইনে সরবরাহ শুরু হয়। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ওই দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে এলএনজি অপারেশন শুরু করে। এরপর গত ১ মে থেকে দেশে আরও একটি এলএনজি টার্মিনাল যুক্ত হয়। ভাসমান এই টার্মিনালটির মালিকানা রয়েছে সামিট পাওয়ারের হাতে। এক্সিলারেটের মতো একই প্রক্রিয়াতে পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করে সামিট পাওয়ার। চুক্তি অনুযায়ী পেট্রোবাংলা এলএনজি ক্রয় করে আনবে। টার্মিনালটি শুধুমাত্র এলএনজিকে পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপ লাইনের সরবরাহ করবে। এতে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) তে তাদের অর্থ পরিশোধ করবে পেট্রোবাংলা। জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এটি অনেকটা বাসা ভাড়া নেয়ার মতোই। পেট্রোবাংলা টার্মিনালটি ব্যবহার করুক বা না করুক এর ভাড়া ঠিকই পরিশোধ করতে হবে। এক সময় দেশে ভাড়ায় চালিত যে বিদ্যুত কেন্দ্র ছিল তাও সেই রকম। আর দেশে এখন যেসব আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে তারাও সেই একই রকম। বিদ্যুত উৎপাদনক্ষম থাকলে কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত নেয়া হোক বা না হোক তাদের একটি ক্যাপাসিটি পেমেন্ট প্রদান করতে হবে। এলএনজি টার্মিনালও একই ধরনের। প্রতিদিন তাদের ভাড়া দিতে হয় এক লাখ ৫৯ হাজার ডলার। এরসঙ্গে পরিচলন এবং সংরক্ষণ ব্যয় রয়েছে দৈনিক ৪৫ হাজার ৮১৪ ডলার আর পোর্ট চার্জ বা বন্দরের ব্যয় রয়েছে প্রতিদিন ৩২ হাজার ডলার। এসবগুলো হিসেব যোগ করলে একটি এলএনজি টার্মিনাল ব্যবহার হোক বা না হোক এর পেছনে দৈনিক খরচ হয় দুই লাখ ৩৭ হাজার ডলার। একটি এলএনজি টার্মিনাল যদি আট মাস বসে থাকে তাহলে ব্যবহার না করেই সরকারকে ৪৮৩ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরাও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। পাইপ লাইন হওয়ার আগেই কেন এই এলএনজি টার্মিনাল বিভিন্ন সময় প্রশ্নও উঠেছে। আমরা জিটিসিএলকে নানা ভাবে চাপও দিয়েছি। কিন্তু সব সময় ইচ্ছা থাকলেও সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারী কোম্পানি সব কিছু করতে পারে না। এটি একটি বাস্তবতা। এখানে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসা করেন তাদের প্রভাব সরকারী এসব কোম্পানি প্রধানদের চেয়েও অনেক বেশি। ফলে পাইপ লাইন না হওয়ার দায় এককভাবে এদের দেয়া ঠিক নয়। আসলেই তারা কোথাও কোথাও খুব অসহায়। কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি জিটিসিএল গত জুলাই মাসের প্রথমার্ধে পাইপ লাইন চালু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু আগস্ট পেরিয়ে গেলেও পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। এখন বলা হচ্ছে আগামী বছর প্রথম দিকে পাইপ লাইন দুটিতে গ্যাস সঞ্চালন করতে পারবে তারা। এপ্রিলে দেশে এলএনজি সরবাহের জন্য দ্বিতীয় ভাসমান টার্মিনালটি আনা হয়। আর গত ১ মে থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে টার্মিনালটি। কিন্তু পাইপলাইন তৈরি না হওয়াতে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি এলএনজি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার এলএনজি সেলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চুক্তিতেই এসব অর্থ দেয়ার বিধান রয়েছে। ফলে আমরা নিতে পারি বা না পারি সেটি তাদের দেখার বিষয় না। আর এখানে আমরা নিতে পারছি না আমাদের ব্যর্থতার কারণে। সেখানে উদ্যোক্তার কিছু করার নেই। উদ্যোক্তা তার কারণে ব্যর্থ হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। জিটিসিএল প্রথমধাপে মহেশখালী দ্বীপের জিরো পয়েন্ট থেকে চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে। এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের ৩০ কিলোমিটার আরও একটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। প্রথম পাইপলাইনটির সরবরাহ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট আর দ্বিতীয় পাইপলাইনের সরবরাহ ক্ষমতা এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গত অক্টোবরে দেশে প্রথম দফা এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়। সামিটের সঙ্গে এলএনজি সররাহের দ্বিতীয় ভাসমান টার্মিনালের সঙ্গে চুক্তির পর টনক নড়ে জিটিসিএল এর। তারা ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত আরও একটি পাইপলাইন নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতে দেশে গ্যাস প্রাপ্তি বিশ্লেষণ করে এ ধরনের প্রকল্প প্রহণ করা উচিত ছিল যা করেনি পেট্রোবাংলা। এখন বলা হচ্ছে মাতারবাড়িতে সরকার স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। এর অর্থ দাঁড়ায় ওই টার্মিনালটি কাজ শুরু করলে আরও একটি পাইপ লাইন নির্মাণ করতে হবে। জিটিসিএল সূত্র বলছে, গত মার্চে পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর জিটিসিএল এর তরফ থেকে বলা হয় পাইপ লাইনের কাজ শেষ হবে বছরের জুনে। এখন বলা হচ্ছে এ বছর পাইপ লাইনের কাজ শেষই হবে না। জিটিসিএল বলছে মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম আনার পর তা জাতীয়গ্রিডে সরবরাহ করতে হলে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট থেকে কুমিল্লার বাখরাবাদ পর্যন্ত ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের আরও একটি পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। যে পাইপ লাইনটি নির্মাণের কাজও শেষ করতে পারেনি জিটিসিএল। জানতে চাইলে জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোঃ আল মামুন বলেন, এ বছর আগাম বৃষ্টির জন্য আমরা নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারিনি। তিনি বলেন, এখন পাইপ লাইন নির্মাণের কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে টেস্টিং এবং ভালব লাগানোর কাজ হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আবার কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন মহেশখালী আনোয়ারা ৭৯ কিলোমিটার পাইপলাইনের নির্মাণ কাজের ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার বাদ রয়েছে। আর চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বাখরাবাদ পর্যন্ত পাইপ লাইনের ১৮১ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬৫ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে পাইপ লাইনের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
×