ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকিং কমিশন গঠন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হচ্ছে না

প্রকাশিত: ১২:০৪, ১২ জুলাই ২০১৯

ব্যাংকিং কমিশন গঠন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হচ্ছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংক খাতের অনিয়ম বন্ধের পাশাপাশি এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত কয়েকবছর ধরে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি তোলা হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবারের বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এক অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরও ব্যাংকিং কমিশন গঠন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হচ্ছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হলে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরী। তার মতে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া কমিশন প্রতিষ্ঠা করেও কোন লাভ হবে না। প্রসঙ্গত, খেলাপী ঋণের লাগাম টানাসহ ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য গত কয়েক বছর ধরে আলাদা কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করে আসছে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। এর বাইরেও ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তবে তার এই ঘোষণার আড়াই বছর পার হলেও কমিশন গঠন সম্ভব হয়নি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক কমিশন গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবারের বাজেট বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কোনও ধরনের সংস্কার আমরা লক্ষ করিনি। ব্যাংক থেকে কোনও ঋণগ্রহিতা ঋণ নিয়ে তা শোধে ব্যর্থ হলে তার জন্য কোনও ধরনের এক্সিটের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা এবার এই কার্যক্রমটি আইনী প্রক্রিয়া সুরাহার লক্ষ্যে একটি কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও ব্যাংক ক্রাপ্টসি আইনের হাত ধরে ঋণগ্রহীতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’ তবে আলাদা করে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দরকার নেই বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা কী, তা সবারই জানা। আবার সমাধান কীভাবে হবে, তাও সবার জানা।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং কমিশনের কাজ হলো সুপারিশ করা। এরই মধ্যে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন মহল সরকারকে বেশকিছু সুপারিশ করেছে। কিন্তু কোন সমাধান হচ্ছে না।’ মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কমিশন না করেও সমাধান করা সম্ভব। আর সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে কমিশন করেও কোন ফল আসবে না।’ অবশ্য সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সিপিডি মনে করে ব্যাংক খাতের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা দরকার। তিনি বলেন, ‘সিপিডি থেকে আমরা অনেকদিন ধরেই বলছি ব্যাংকিং কমিশনের কথা। এবারের বাজেটেও ব্যাংকিং কমিশনের বিষয়ে ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বর্তমান ও আগের অর্থমন্ত্রীও বলেছিলেন।’ ব্যাংকিং কমিশনের কাজ কী : মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ একজনকে ব্যাংকিং কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেবে সরকার। তিনি ব্যাংকিং কমিশনের কাজের চিত্র তুলে ধরেন। ১. খেলাপী ঋণের লাগাম টানাসহ দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে এ-সংশ্লিষ্ট আইন সংস্কারের বিষয়ে কাজ করবে; ২. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান করবে; ৩. ইচ্ছাকৃত খেলাপী আর অনিচ্ছাকৃত খেলাপী আলাদা করার কাজ করবে; ৪. টাকা কীভাবে আদায় করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করবে; ৫. আইনী কাঠামোর সংস্কার করবে; ৬. খেলাপী ঋণসহ অন্যান্য সমস্যার মূল চিহ্নিত করবে; ৭. ব্যাংক বোর্ডের গঠনের জন্য নীতিমালা করবে; ৮. আইন প্রয়োগে সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং আইনের পরিবর্তনে কাজ করবে এবং ৯. কমিশন ব্যাংকিং খাতের দক্ষ, যুগোপযোগী ও সুশাসনভিত্তিক পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেবে। সিপিডির এই ফেলো বলেন, কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার একটা রূপরেখা দেবে এই কমিশন। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ ধরনের একটি উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সাধারণত, ব্যাংকিং কমিশন হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো এটাও স্থায়ী কমিশন হবে না। এটা হবে ৩ বা ৬ মাসের জন্য। কমিশন এই সময়ের মধ্যে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দেবে। তাতে যেসব সুপারিশ করা হবে, সেসব কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তারও গাইডলাইন বা রূপরেখা থাকবে। সমন্বয়ের অভাবে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রকল্প পরিচালক পদে ঘন ঘন পরিবর্তন আসেনি। যথাসময়ে হচ্ছে অর্থছাড়। এমনকি প্রয়োজনীয় জনবলও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু উপকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে নির্মিতব্য গ্রিড থেকে বিদ্যুত অবমোচনে যথাসময়ে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারছে না বিতরণ সংস্থাগুলো। এ কারণে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনে টাওয়ার স্থাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে প্রকল্প ব্যয়ের পাশাপাশি বাড়ছে বাস্তবায়নের সময়ও। এমন চিত্র উঠে এসেছে ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমন্টে প্রকল্পে। বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। গত জুনে প্রকল্পটি নিবিড় পরিবীক্ষণ করে সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। পরে সংস্থাটির দেয়া প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল মনসুর মোঃ ফয়জুল্লাহ বলেন, ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্টে প্রকল্পে যেসব ত্রুটি রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সুপারিশ দিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব। এমনকি এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা কি ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোও জানতে চাওয়া হবে। আমরা শুধু সুপারিশ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করব না। প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে শতকরা ৭৫ দশমিক ৬৮ ভাগ ভৌত অগ্রগতি হয়েছে। প্যাকেজ ৩, ৪, ৮ ও ৯ এর কাজ প্রায় শেষ হওয়ায় আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বারোইয়ার হাট, রামগঞ্জ, ভালুকা, মহাস্থানগড়, বগুড়া, বরিশাল (উত্তর), জলঢাকা ও সৈয়দপুর উপকেন্দ্রের আওতাধীন এলাকার জনগণ প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। তবে প্যাকেজ ২ ও ৬ এর নির্মাণ কাজ বেশ পিছিয়ে থাকায় শিকলবাহা বিদ্যুতকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের অবমুক্তি এখন বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণ এই প্রকল্পের সুবিধা পুরোপুরি পাবেন না। আইএমইডি বলছে, বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুত উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শিকলবাহায় নির্মিত ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত অবমুক্ত, রামপুরা ও শিকলবাহার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুত সরবরাহ এবং ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশনের মাধ্যমে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য ‘ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকারের নিজস্ব তহবিল, পিজিসিবি এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) যৌথ অর্থায়নে মোট ২ হাজার ৪২৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। এরপর আবারও একনেকে প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার ৫১৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া বর্ধিত মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যাকেজ-১ এর অধীনে শিকলবাহা ২৩০/১৩২ কেভি বিদ্যুত উপকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়েছে। এই উপকেন্দ্রের মাধ্যমে ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত অবমুক্ত করে দোহাজারী, শাহমিরপুর, জুরদা, মদুনাঘাট সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যোগ করা হয়েছে। প্যাকেজ-২ ও প্যাকেজ-৬ এর নির্মাণ কাজ পিছিয়ে থাকায় রামপুর ও আগ্রাবাদ উপকেন্দ্র যথাসময়ে পরিপূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হবে না। ফলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত সঞ্চালন নিশ্চিত পিছিয়ে যাবে। প্যাকেজ-৬ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো দ্রুত দূর করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপকেন্দ্রগুলোর সাইট নির্ধারণে সমন্বয় না থাকায় নির্মীয়মান গ্রিড থেকে বিদ্যুত অবমোচনের জন্য বিতরণকারী সংস্থাগুলো যথাসময়ে প্রকল্প নিতে পারেনি। বিতরণকারী সংস্থার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আরও সুবিধাজনক জায়গায় গ্রিড উপকেন্দ্রগুলো স্থাপন করা যেত। এছাড়া টাওয়ার স্থাপনের জন্য ব্যক্তিমালিকাধীন জমির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না থাকাও প্রকল্পের অন্যতম দুর্বল দিক। ফলে বর্তমানে টাওয়ার নির্মাণ ও লাইনের কাজ শেষ করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বিদ্যুত সঞ্চালন লাইনে টাওয়ার স্থাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টাওয়ার স্থাপনের জায়গা ও লাইনরুট নির্ধারণে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং নৌবাহিনীর সঙ্গে আরও আগে আলোচনা করা হলে সৃষ্ট জটিলতা ও সময় ব্যয় হতো না।
×