অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ শেয়ারবাজারে গত কয়েক মাসের দরপতনের পর ব্যাপক আলোচনায় উঠে আসে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) পূর্ব মূলধন বৃদ্ধিজনিত শেয়ার বা প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুটি। আইপিও শেয়ারের মাধ্যমে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন অভিযোগে লক-ইন (বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা) এর মেয়াদ বাড়ানোর দাবি উঠে। এ নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষে চলমান লক-ইন এর ১ বছরের মেয়াদ অপরিবর্তিত রেখে প্রসপেক্টাস প্রকাশের দিনের পরিবর্তে লেনদেন শুরুর দিন থেকে গণনা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইন ৩ বছর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ ১ বছরের লক-ইনেই প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রয়যোগ্য হওয়ার জন্য গড়ে প্রায় আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এরসঙ্গে লক-ইন এর মেয়াদ আরও ২ বছর বাড়ানো হলে, সেটা সাড়ে ৪ বছরে পৌঁছাবে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ডিএসইর পক্ষ থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইন এর মেয়াদ ১ বছর রেখে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, সেটাকে যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় লক-ইনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কমিশনের বিশ্লেষণ করা দরকার। এক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জ, ইস্যু ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইনের বিষয়ে ২টি দিক আছে। আমাদের দেশের যেকোন কোম্পানির লেনদেনের শুরুতে শেয়ার দর অনেক বেশি হারে বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে লক-ইনের মেয়াদ কম হলে প্লেসমেন্ট ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিতে পারে। অন্যদিকে লক-ইন এর মেয়াদ বেশি হলে আবার ভাল কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে নিরুৎসাহিত হবে।
বিএসইসির সাবেক কমিশনার আরিফ খান বলেন, প্লেসমেন্ট শেয়ারে লক-ইন ১ বছর থাকাটাই ভাল মনে হচ্ছে। অন্যথায় ক্যাপিটাল রেইজিং হবে না। এখন বাংলাদেশে এসব বিষয়ে অপব্যবহার করা হয়। সমস্যা তো এখানেই। যে কারণে ভাল কাজ করা যায় না।
দেখা গেছে, গত ৫ বছরে ৬৪টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩টি কোম্পানি থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) পূর্ব প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে। যেসব শেয়ার সেকেন্ডারি মার্কেটে বিক্রি উপযোগী হতে গড়ে ২.৬৫ বছর সময় লেগেছে।
ওই সময়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রিযোগ্য বা লক-ইন মুক্ত হতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগবে ভিএফএস থ্রেড ডাইংয়ের। এ কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীদের ৬ বছর ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে। এরপরের অবস্থানে থাকা সিলকো ফার্মাসিউটিক্যালসে লাগবে ৫ বছর। এছাড়া ইন্ট্র্যাকো রিফুয়েলিং স্টেশনে ৪ বছর ১ মাস এবং নিউ লাইন ক্লোথিংস, রানার অটোমোবাইলস ও বসুন্ধরা পেপার মিলসে ৪ বছর করে লক-ইন থাকবে।
এদিকে সবচেয়ে কম সময়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার লক-ইন মুক্ত হয়েছে এএফসি এ্যাগ্রো বায়োটেকে। এ কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রয়যোগ্য হয়েছে ১ বছর ২ মাসে। এছাড়া মোজাফ্ফর হোসাইন স্পিনিং মিলস, ন্যাশনাল ফিড মিল ও হা-ওয়েল টেক্সটাইলের ১ বছর ৫ মাসে এবং ফার কেমিক্যালের ১ বছর ৬ মাসে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রয়যোগ্য হয়েছে।
প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে একটি গ্রুপ বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেখানে গ্রুপটি মূল বাজারের বাহিরে আরেকটি বাজার গড়ে তুলেছে বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এসব মিলিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ারে নিরুৎসাহিত করতে লক-ইন সময় বাড়ানোর দাবি উঠে। শুরুতে ৩ বছর লক-ইনের কথা বলা হলেও ডিএসই থেকে ১ বছরই চাওয়া হয়। তবে সেটা প্রসপেক্টাসের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশের দিনের পরিবর্তে লেনদেন শুরুর দিন থেকে চাওয়া হয়।
অবশেষে গত ২৯ এপ্রিল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বিতর্কিত প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। সভায় বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আগামীতে বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে প্লেসমেন্টে কোন শেয়ার ইস্যু করার সুযোগ থাকবে না। একইসঙ্গে আইপিওকালীন সকল শেয়ারে ৩ বছর লক-ইন থাকবে। যা প্রসপেক্টাসের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশের দিনের পরিবর্তে লেনদেন শুরুর দিন থেকে গণনা করা হবে। তবে ১৬ মে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আরেক বৈঠকে লক-ইন নিয়ে নমনীয় অবস্থানে আসার ইঙ্গিত দেয় কমিশন।
১৬ মে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান জানান, ২৯ এপ্রিল শেয়ারবাজার নিয়ে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জনমত জরিপের পরে চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ারে ৩ বছর লক-ইন ঠিক আছে। তবে অন্যদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জনমত জরিপকে বিবেচনায় নিতে হবে। একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।
এর আগে ১৩ মে প্লেসমেন্ট শেয়ারে সর্বোচ্চ ১ বছর বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা (লক-ইন) চেয়ে কমিশনে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)। সংগঠনটির পক্ষে প্লেসমেন্ট শেয়ারে সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছর লক-ইন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে প্লেসমেন্ট শেয়ারে সর্বোচ্চ ১ বছরের লক-ইন রয়েছে। কিছু কিছু দেশে এই লক-ইন আরও কম। যেমন ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও সিঙ্গাপুরে সর্বোচ্চ ১ বছরের লক-ইন রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও হংকংয়ে ৬ মাস এবং মায়ানমারে সর্বোচ্চ ৩ মাসের লক-ইন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।