ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলা, শিকড় থেকে শিখরে...

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ১০ জুন ২০১৯

হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলা, শিকড় থেকে শিখরে...

সমুদ্র হক ॥ পরাধীনতার হাত থেকে দেশ মুক্ত হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করেছিলেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদশকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হলে সর্বাগ্রে দরকার শিক্ষার উন্নয়ন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। তাই তিনি শূন্য কোষাগার নিয়ে চরম অর্থ সঙ্কটে থেকেও একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক স্কুলকে সরকারী করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও ২৬ হাজার স্কুল সরকারী করেছেন। তিনি গ্রামকে শহরের মতো করে গড়ে তোলা- অর্থাৎ গ্রামকে শহরের সব সুবিধায় এগিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষার উন্নয়নে নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উদার মানসিকতার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের একটি বেসরকারী স্কুল সরকারেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় আমতলী মডেল স্কুল (শিবগঞ্জ, বগুড়া) থেকে এবারই প্রথম অংশগ্রহণকারী ২৩ পরীক্ষার্থীর ২৩ জনই জিপিএ-৫ পেয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে জেএসসিতে ২৯ জনের মধ্যে ১৩ জন এবং পিএসসিতে ৪৯ জনের মধ্যে ৪৯ জনই এ প্লাস। ২০১৭ সালে জেএসসিতে ২৭ জনের মধ্যে ২৫ জন এবং পিএসসিতে ৩৩ জনের মধ্যে ৩২ জনই এ প্লাস। ২০১৬ সালে জেএসসিতে ২৬ জনের মধ্যে ২৬ জনই এবং পিএসসিতে ৩১ জনের মধ্যে ২৩ জন এ প্লাস পেয়েছে। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। এই গ্রামে স্থাপিত স্কুলটির নাম আমতলী মডেল হাইস্কুল (ইআইআইএন ১৩৭৬৬২, কোড-৪৫১১), যা শহরের স্কুলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে শহরের চেয়েও উন্নত। তার প্রমাণ দিয়েছে এই স্কুল। সম্প্রতি ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত শিক্ষামেলায় এই স্কুলের সার্বিক কর্মকান্ড তুলে ধরা হয়েছে। একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলের এমন আয়োজন ঢাকায় এই প্রথম। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, শিক্ষাঙ্গন শুধু পুঁথিগত বিদ্যার পীঠস্থান নয়। বগুড়া নগরী থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই স্কুল। মাত্র ২৩ শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে। উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, ভাষাসৈনিক, সাবেক তথ্য সচিব ও সাংবাদিক বাহাউদ্দীন চৌধুরী। বর্তমানে শিক্ষার্থী সাত শতাধিক। শুরু থেকেই প্রগতির ধারাকে গুরুত্ব দিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। অল্পদিনেই স্কুলটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, পাঠাভ্যাস, সম্প্রীতি, সমাজমনস্ক, সংস্কৃতি সচেতনতা ও মানবিকবোধ জাগ্রত করে এবং লোকজ সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্ব দিয়ে শিশুমনেই বীজ বপন শুরু হয়। গ্রামীণ সব কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়। যে জাতি তার নিজস্ব^ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে উন্নত সেই জাতি বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াবেই। সংস্কৃতির এই ধারা সঙ্গে নিয়ে আলোচ্য স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মীর লিয়াকত আলী প্রকাশ করলেন সহজ কথায় শিশু-কিশোরদের পাঠোপযোগী প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল হালিমের লেখা ‘বাংলাদেশের জন্মকথা’ বইটি। সেই ছোট্ট বই পাঠ করে শিশুরা জানতে পারে একটি জাতির জন্মের ইতিহাস। যাতে শিশুমনে জেগে ওঠে দেশপ্রেম। ওই বই অবলম্বনে প্রকাশক নির্মাণ করেন প্রামাণ্য ভিডিওচিত্র। বিশেষ করে আমতলী মডেল স্কুল শিক্ষার্থীদের সুদূরপ্রসারী ভাবনায় ‘বাংলাদেশের জন্মকথা’ নামের ৫৩ মিনিটের যে ভিডিওচিত্র বানানো হয়েছে তা সর্বজন প্রশংসিত। সেই প্রামাণ্যচিত্রে বিশ্বের বঙ্গীয় এই ব-দ্বীপে কিভাবে সভ্যতার ধারাবাহিকতায় কয়েকটি কাল অতিক্রম করে একটি জাতির জন্ম হয়েছে তা সৃষ্টিশীলতায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে তৈরি করলেন এলাকার একজন ভূমিদস্যু রাজাকারের অত্যাচার ও বাড়ি দখলের স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র। ১৬ মিনিটের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে যে কটি বিষয় একসঙ্গে উঠে এসেছে তা হলো, হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধন, মুক্তিযুদ্ধে মানুষে মানুষে সহমর্মিতা ও বিজয় অর্জনের পর আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার দীক্ষা। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, সব মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে পারে। স্কুলের আরেকটি অঙ্গসংগঠন আমতলী মডেল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কুসংস্কার দূর করতে ও সামাজিক চেতনা জাগাতে গণমুখী সাতটি গানের একটি মিউজিক ভিডিও বানানো হয়। ‘গুজবের তাবিজ’ নাটিকাটি কুসংস্কারের থাবা প্রতিহত করতে সচেতনতা জাগায়। ভাষা আন্দোলনের ওপর আরও একটি নাটিকা ‘প্রতিজ্ঞা’র মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভাষা আন্দোলন কি এবং কেন তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। লোকজ সংস্কৃতির জারি-সারি গানের মর্মকথা শিশুদের মনে গেঁথে দেয়ার কার্যক্রমও হাতে নেয়া হয়। স্কুলের নিজস্ব সঙ্গীতও রয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে সুস্থ শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চার প্রসারে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘আমতলী সাংস্কৃতিক একাডেমি’। আমতলী মডেল স্কুলকে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিকতার আলোকে। এই স্কুলে রয়েছে ভাষাসৈনিক ও বাহাউদ্দীন চৌধুরী পাঠাগার, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, স্কুলের নামে ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ছেলেমেয়েদের আলাদা স্যানিটেশন ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, শরীর চর্চা, শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব, হাতের লেখা সুন্দর করার শিক্ষা এবং প্রতি বৃহস্পতিবার ব্যবহারিক জ্ঞানসহ নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা। আরও রয়েছে স্কুলের নিজস্ব উদ্যোগে বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা, মেডিক্যাল ক্যাম্প, শিক্ষা সফর, মেধাভিত্তিক পুরস্কার, কেউ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার কাছ থেকে নেয়া এক বছরের বেতন ফেরতের ব্যবস্থা, স্কুলের নিজস্ব পরিবহনসহ শহুরে জীবনের সব সুবিধার সঙ্গে রয়েছে বাড়তি অনেক সুবিধাও। স্কুল প্রাঙ্গণে আছে গ্রামবাংলার বিলুপ্তপ্রায় দুই শ’ জিনিসপত্র। বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ প্রায় এক হাজার প্রতিকৃতি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ২শ’ ছবি। দর্শনীয় স্থানের ছবি। দেশ-বিদেশের ধাতব ও কাগজের মুদ্রা। ফেলে দেয়া জিনিসপত্র দিয়ে শিল্পকর্ম। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে স্কুলের শতভাগ এ প্লাস ও পঞ্চাশ ভাগ বৃত্তি পাওয়ার গৌরবও রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির বিশাল প্লাজায় তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত শিক্ষামেলায় স্কুলের কর্মকান্ডের সব বিষয় উপস্থাপিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন এমপি। মুগ্ধ হয়ে বললেন, এই স্কুল অন্যদেরও গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা দেবে। বিশেষ অতিথি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রেজাউল আহসান বলেন, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্কুল পরিচালনা করলে তা যে শিশুমনে দেশপ্রেম গেঁথে দেয়, তার প্রমাণ দিলো এই স্কুল। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা একজন সাংবাদিক। তিনি প্রমাণ করে দিলেন, সাংবাদিকরা তাদের দায়বদ্ধতা থেকে শিশুদের মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির ধারায় চেতনা জাগিয়ে দিতে দৃষ্টান্তমূলক মডেল স্কুল গড়ে তুলতে পারেন। গত ২৫ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত তিনদিনের এই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের সাবেক চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। বিশেষ অতিথি ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম। শেষদিনে প্রধান অতিথি ছিলেন পাট ও বস্ত্রবিষয়ক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এমপি। তিনি বললেন, এমন একটি স্কুলের বাতি দিয়ে আরও অনেক স্কুল তৈরি করা যায়, যা শিক্ষার বাতিঘর হয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশকে।
×