ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আসছে ২০ বিলিয়ন ॥ দুই রেলপথ নির্মাণে সৌদি বিনিয়োগ

প্রকাশিত: ১১:০২, ২৯ মে ২০১৯

আসছে ২০ বিলিয়ন ॥ দুই রেলপথ নির্মাণে সৌদি বিনিয়োগ

এম শাহজাহান ॥ ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত চলবে দ্রুতগতি সম্পন্ন ‘হাইস্পিড’ ট্রেন। এরপর ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যখন সংযোগ ঘটবে তখন এই ট্রেনে চেপেই পৌঁছানো সম্ভব হবে মিয়ানমার পেরিয়ে চীন পর্যন্ত। একই সঙ্গে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকার সঙ্গে বরিশাল ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের বড় দুটি এই রেল প্রকল্পে আসবে সৌদি আরবের বিনিয়োগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সৌদি আরব সফরের সময় রেলপথ অবকাঠামো নির্মাণে ২০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের একটি প্রস্তাব তুলে ধরবে সরকার। ইতোমধ্যে এ চলমান দুটি রেলপথ নির্মাণে সৌদি আরব ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর শেষ করে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে সরাসরি সৌদি আরবে যাবেন। আগামী ৩১ মে মক্কায় অনুষ্ঠেয় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে (ওআইসির) অংশ নেবেন তিনি। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ রমজানের শেষ নাগাদ মক্কায় অনুষ্ঠেয় ১৪তম ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন) সম্মেলনে যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওই সম্মেলন শেষে দুদেশের সরকার প্রধান বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ দুটি রেল প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির প্রক্রিয়াটি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সৌদি আরব সফরটি রাজনৈতিক হলেও সেখানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুটি রেল প্রকল্পসহ আরও চারটি প্রকল্পের ব্যাপারে সৌদি আরবের বিনিয়োগ চাওয়া হবে। তিনি বলেন, সৌদি আরবের বিনিয়োগে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে দ্রুতগতির হাইস্পিড ট্রেন চালু করা হবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা-বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি সৌদি সরকারের অর্থায়নে টেলিকমিউনিকেশন খাতে ৫-জি সেবা চালু, লালমনিরহাটে এভিয়েশন হাব নির্মাণ, ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্ট ফান্ড এবং পুঁজিবাজারের জন্য বিনিয়োগ চাওয়া হবে। কাজী আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, সৌদি আরবের কাছে এ মুহূর্তে বিনিয়োগের জন্য ২৫০ বিলিয়ন ইউএস ডলার রয়েছে। ওই অর্থ সৌদি আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের চলমান সব বড় প্রকল্পে সৌদি আরব বিনিয়োগ করতে চায়। প্রধানন্ত্রীর আসন্ন সফরে বিনিয়োগ-বাণিজ্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়ের অগ্রগতি হয়ে বলে আশা করছি। এদিকে ওআইসি সম্মেলনে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবে বাংলাদেশ। ওআইসি সম্মেলনে অংশ নেয়া ছাড়াও সরকারপ্রধানের ওমরাহ পালনের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরব থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর ফিনল্যান্ড সফরে যাওয়ার আলোচনা চলছে। সে ক্ষেত্রে ঈদের পর তিনি দেশে ফিরতে পারেন বলে আভাস দেয়া হয়েছে। বড় ৬টি প্রকল্পে সৌদি আরবের বিনিয়োগ চূড়ান্ত হচ্ছে ॥ বড় ছয়টি প্রকল্পে সৌদি আরবের বিনিয়োগ চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শুধু রেলপ্রকল্পে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব। এরপরই রয়েছে টেলিকম খাত। এ খাতে ফাইভ-জি সেবা দিতে সৌদি আরব বাংলাদেশে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া দুবাই ও সিঙ্গাপুরের মতো একটি এভিয়েশন হাব করা হবে বাংলাদেশে। এই প্রকল্পে সৌদি আরবের বড় অঙ্কের বিনিয়োগের কথা রয়েছে। সৌদি আরবের আগ্রহে বাংলাদেশ এ ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণসহ যাবতীয় কার্যক্রম শীঘ্রই শুরু করা হবে। এছাড়া সৌদির বিনিয়োগ আনতে ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্ট ফান্ড নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোন কোন খাতে সৌদি আরবের বিনিয়োগ হতে পারে সে সম্পর্কে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই ও কার্যক্রম শুরু করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব। এছাড়া বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে সৌদি আরবের আগ্রহ রয়েছে। চীনের মতো সৌদি আরবও এদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে চায়। পুঁজিবাজারে শীঘ্রই সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব। জানা গেছে, সৌদি আরবের বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর পরিষ্কার ধারণা দিতে একটি কনসেপ্ট নোট চূড়ান্ত করে এনেছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরের সময় এই কনসেপ্ট নোট সৌদি সরকারের কাছে তুলে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সৌদি বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নির্বাহী মনিটরিং কমিটির তিনটি সভা এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে আরেকটি বৈঠক গত ১৪ মে অনুষ্ঠিত হয়। আগামী অর্থবছরের মধ্যেই সৌদি আরবের বিনিয়োগ দেশে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, সৌদির পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের ২৫০ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল অর্থনীতি নির্ভর এই দেশটি। মূল লক্ষ্য, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বহুমুখীকরণ। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে সৌদি আরবের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে রোডম্যাপ গ্রহণ, বিনিয়োগে ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করা, ভিশন-২১ এর মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যমাত্রার মতো কর্মসূচীতে আকৃষ্ট হয়েছে সৌদি আরব। বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুত জ্বালানি, সেবা ও উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে বিনিয়োগ করতে চায় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি। ইতোমধ্যেই সৌদি আরর সফরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সৌদি বাদশা ও প্রিন্স সালমান। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিগুলো দ্রুত কার্যকরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। হাইস্পিড ট্রেনে সৌদি বিনিয়োগ ॥ প্রায় ১৩০ বছরের স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। এদেশে দ্রুত গতির হাইস্পিড ট্রেনে বিনিয়োগ করবে সৌদি আরব। পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাওয়া যাবে ট্রেনে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারে রেলপথে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা। এরপর ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যখন সংযোগ ঘটবে তখন ট্রেনে চেপেই পৌঁছানো সম্ভব হবে মিয়ানমার পেরিয়ে চীন। চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এখন দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগিয়ে গেলে আর মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে আগামী ২০২২ সালে পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতপানে ছুটবে যাত্রীবাহী ট্রেন। চট্টগ্রাম থেকে অপরূপ প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে মাত্র দেড়-দুই ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হবে কক্সবাজার শহরে। এই সার্ভিস চালু হলে বর্তমানের ৬-৭ ঘণ্টার যাত্রা হয়ে যাবে মাত্র দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টার। এই হাইস্পিড ‘বুলেট ট্রেন’ চলবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০০ কিলোমিটার গতিতে। বাংলাদেশের বর্তমান আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর গতি ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। বর্তমান ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন লাইনের দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। তবে প্রস্তাবিত বুলেট ট্রেনের দৈর্ঘ্য হবে ২৩০ কিলোমিটার। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলাকেই রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। বরিশাল জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার লক্ষ্যে ভাঙ্গা হতে বরিশাল হয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিশদ নকশা প্রণয়নসহ সম্ভাবতা সমীক্ষা প্রস্তাব গত ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর পরিকল্পনা মন্ত্রীর অনুমোদন পায়। পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত বছরের ১৯ জুন তারিখে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা চলছে। তিনি বলেন, ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশালের পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল সংযোগ স্থাপিত হবে।
×