ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফলন ভাল হলেও এক মণ ধানে এক কেজি গরুর মাংস কেনা যায় না ;###;উৎপাদন খরচও ধান বিক্রি করে উঠছে না

বাম্পার বোরো ফলনেও হতাশ চাষী ॥ এক মণ ধান বেচে ওঠে না কামলার মজুরি

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ১৪ মে ২০১৯

 বাম্পার বোরো ফলনেও  হতাশ চাষী ॥ এক মণ ধান বেচে ওঠে  না কামলার মজুরি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কাঠফাটা রোদ উপেক্ষা করে রোজায় থেমে নেই ধানকাটা। বোরো মৌসুমের বেশিরভাগ ধান পেকে গেছে। কৃষকরা সে ধান শ্রমিক সঙ্কটে ঘরে তুলতে পারছেন না। শ্রমিকের মূল্য বেশি, অনেক এলাকায় পাওয়াই যাচ্ছে না। আবার অনেক কষ্টে ধান ঘরে উঠালেও মণ ধান বিক্রি করে দেয়া যাচ্ছে না শ্রমিকের মূল্য। বর্তমান বাজারের মূল্য হিসেবে দেখা গেছে এক মণ ধান বিক্রি করে কেনা যায় না এক কেজি গরুর মাংস। ধানের মূল্য নিয়ে যখন এই অবস্থা তখন বার বার হতাশা নিয়ে জমিতে নুয়ে পড়া ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আফসোস বাড়ছে কৃষকদের। বোরো বাম্পার ফলন হওয়ার পর দাম নিয়ে একদিকে বাড়ছে হতাশা অন্যদিকে ভবিষ্যতে নিজের প্রয়োজনের বেশি ধান উৎপাদন করবে কিনা তা নিয়েও ভাবছে চাষী। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ধানই পেকে গেছে। অনেক জায়গায় রাতদিন পরিশ্রম করে ধানকাটা হচ্ছে। আবার কোথাও শ্রমিক সঙ্কটের কারণে থেমে আছে। কয়েক দিন আগের ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে। ফণীর প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়ার কারণে অনেক এলাকায় ধান পড়ে গেছে জমিতে। এই পড়ে যাওয়া ধান দ্রুত কাটার হিড়িক পড়েছে। পড়ে যাওয়া সোনার ফসল কৃষক ঘরে উঠাতে ব্যস্ত থাকলেও শ্রমিক সঙ্কট একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও। প্রতি দিনমজুরের মজুরি উঠেছে ৬৫০ থেকে ৭শ’ টাকা। এক মণ ধান বিক্রি করেও একজন কামলার মজুরি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। কারণ বাজারে বর্তমানে এক মণ ধানের দাম প্রকারভেদে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা। শুধু তাই নয় এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক বাজার থেকে এক কেজি গরুর মাংসও কিনতে পারছেন না। কেননা বাজারে এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬শ’ টাকা করে। এদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, শনিবার পর্যন্ত সারাদেশে ৪৯ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটায় এগিয়ে রয়েছে হাওড় অঞ্চলের জেলাগুলো। হাওড়ের সাত জেলায় প্রায় শতভাগ জমির ধান ঘরে তোলা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। তবে পিছিয়ে রয়েছে উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা এবং রাজধানীর আশপাশ, বিশেষ করে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চল। খাদ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, বোরো মৌসুমে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সেদ্ধ ও দেড় লাখ টন আতপ চাল। এছাড়া ধান সংগ্রহ করা হবে দেড় লাখ টন (এক লাখ টন চালের সমপরিমাণ)। প্রতিকেজি ধানের সংগ্রহমূল্য ধরা হয়েছে ২৬ টাকা। কেজিপ্রতি সেদ্ধ চাল ৩৬ ও আতপ চালের সংগ্রহমূল্য ৩৫ টাকা ধরা হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল শুরু হওয়া ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এদিকে, উৎপাদন খরচের চেয়ে দাম কম হওয়ায় প্রতিমণ ধানে দুই/তিন শ’ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের। প্রতিমণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হাজার টাকা ছাড়ালেও বিক্রি করতে হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকায়। ধানের মোকামগুলোয় ক্রেতা না থাকায় ধানের দাম এখনও নিম্নমুখী। ব্যবসায়ীদের কাছে আমদানি চালের সরবরাহ থাকায় তারা বাজার থেকে ধান কেনায় কম গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার সরকারীভাবে ধান কেনায় এখনও গতি আসেনি। ফলে কৃষক ভাল দামে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যদি ধান-চালের দাম বাড়ে, তাহলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কষ্ট হয়। আবার ধানের দাম কমে গেলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা দরকার। কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের কৃষকদের ভর্তুকি যদি একটু বাড়ানো যায় অর্থাৎ সার, বীজ, সেচের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়াতে পারলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। বিষয়টি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা করা হবে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার প্রতিমণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করছে ১ হাজার ৪০ টাকা। এর কোন প্রভাব নেই বাজারে, মাঠের চিত্র ভিন্ন। হাওড় এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ভেজা ধান প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ থেকে ৫৫০ টাকা। শুকনো ধান ৬শ’ থেকে ৬৫০ টাকা। মাস দুয়েক পর ধানের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, তারা এমন পানির দরে ধান বিক্রি করছেন না। ময়মনসিংহের কৃষক আব্দুল হাফিজ বলেন, আমার জমির কিছু ধান আগেই কেটেছিলাম। ঝড়ে ধান পড়ে গেলেও আর কাটতে পারছি না। কামলা (শ্রমিক) নাই। দুএকজন পেলেও এত বেশি মজুরি যে কাটা মুশকিল। চাষী ওয়াহাব মিয়া বলেন, বাজারে ধানের দাম কম, কেটেইবা কি হবে? ধান কেটে বিক্রি করে এক মণে কামলার দাম দেয়া যায় না। বাজার করতে গেলে বাজারের ব্যাগ ভরে না। এই ধান এত কষ্ট করে কাইটা কি হইবে? কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক সংখ্যক জমিতে এবার বোরো আবাদ হয়েছে। ফলনও হয়েছে বেশ। মাঠের ফলন ও কৃষি-কৃষক সংশ্লিষ্টরা বলছেন ফলন হয়েছে বাম্পার যেখান থেকে সরকার নির্ধারিত চাল সংগ্রহ করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, এবার বোরো আবাদের জন্য জমির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি জমিতে প্রায় ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। সরেজমিন উইংয়ের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মাঠপর্যায়ে যে ফলন দেখেছি এবং যে খবর পাচ্ছি আশা করছি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ফলন পাব। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাকা এ ফসলের ক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া গ্রামের আব্দুল মালেক সিকদার নামে এক কৃষক। এদিকে, রবিবার দুপুরে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা এলাকায় আব্দুল মালেক তার নিজের ধানক্ষেতে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। তার অভিনব প্রতিবাদ দেখে ছুটে আসা এলাকার লোকজন বলছেন, টাঙ্গাইলে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ টাকায়। আর একজন শ্রমিকের দিনমজুরি ৮৫০ টাকা। তাতে আব্দুল মালেকের মতো কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে আব্দুল মালেক গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিমণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরির দাম দ্বিগুণ। এবার ধান আবাদ করে আমরা মাঠে মারা পড়েছি। তাই মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন দিয়েছি। কালিহাতীর আউলটিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান মজনু নামের আরেক কৃষক তার ক্ষেতের পাকা ধান এলাকাবাসীকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন। এলাকাবাসী ধান কেটে অর্ধেক অংশ নিজে এবং বাকি অর্ধেক অংশ ক্ষেত মালিককে দিয়ে দিচ্ছেন। এদিকে, উঠতি বোরোর ন্যায্য দাম না পেয়ে নওগাঁর ধামইরহাটে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষক ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশ নেয়। কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে কৃষকরা বলেন, নতুন বোরো ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না। প্রতিমণ ধানে লোকসান হচ্ছে তিন থেকে চার শ’ টাকা। অন্যদিকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ধান কেনায় চরম বিপাকে পড়েছেন ধান চাষীরা।
×