
পলান সরকার স্মরণে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বই বিনিময় উৎসবে বই নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন গ্রন্থানুরাগীরা
তিনি ছিলেন আলোর পথযাত্রী। ছিলেন জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। বছরের পর বছর ধুলোমাখা পথে প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হেঁটে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন বই। শৈশবে পিতা হারানোয় নিজের পড়াশোনা বেশিদূর না এগোলেও অন্যকে বই পড়ায় উৎসাহ দিয়েছেন আমৃত্যু। আজীবন সমাজকে সমৃদ্ধ করা সেই সাদা মনের মানুষটি হলেন রাজশাহীর পলান সরকার।
তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে মানুষকে বই দিতেন। সেই বই পড়া শেষ হলে আবার নতুন বই দিয়ে আসতেন। এভাবে জীবনের ৯০ বছর অবধি হেঁটে, নিজের টাকায় বই কিনে মানুষকে বই পড়তে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। সেই পলান সরকার স্মরণে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হলো ব্যতিক্রমী এক আয়োজন।
সে আয়োজনে হাতে হাতে ঘুরে বেড়াল গল্প, উপন্যাস, কবিতা কিংবা নানা বিষয়ের মননশীল বই। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি হলো বই বিনিময়। সেই সুবাদে এ বই উৎসবে যারা এসেছিলেন তারা নিজেরাও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন বই। যুক্ত হয়েছিলেন শিক্ষার্থী থেকে চারুশিল্পী, প্রকাশক থেকে গ্রন্থাগারিকসহ নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। এমনকি পথশিশুরাও শামিল হয়েছিল আয়োজনটিতে। তারাও পছন্দের বইটি নিয়ে ঘরে ফিরেছে মনের আনন্দে। এভাবে সকলে মিলে মেতে ওঠে বই আদান-প্রদানের উৎসবে। সেই সঙ্গে ঘটেছে ভাবনার আদান-প্রদান। পলান সরকারকে নিবেদিত উৎসবটির আয়োজন করে মেঘের ধাক্কা নামের সংগঠন।
এ উৎসবে ছিল না কোনো প্রধান বা বিশেষ অতিথি। ছিল না বক্তৃতার বাগাড়ম্বর। শহরের নানা প্রান্তের বইপ্রেমীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিই ছিল উৎসবটির মূল আকর্ষণ। উৎসবটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মেঘের ধাক্কা সংগঠনের পরিচালক কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান বলেন, চাইলেই বই গ্রন্থাগার থেকে কেনা যায়। কিন্তু সেখানে বইয়ের বিনিময় ঘটে না। সেই প্রেক্ষাপটে এ উৎসবে একে অপরকে বই উপহার দেওয়ার পাশাপাশি গড়ে ওঠে আত্মিক সম্পর্ক। সেই সূত্রে ভাবনার বিনিময় ঘটে। বইকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বন্ধন।
ময়মনসিংহের নান্দাইলের শিংরইল গ্রাম থেকে উৎসবে এসেছিলেন ফাইজুল ইসলাম। নিজ গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন আলোর ভুবন নামের পাঠাগার। তার নিয়ে আসা ৫০টি বইয়ের বেশিরভাগই সংগ্রহ করেছেন শিশুরা। আলাপচারিতায় এই গ্রন্থানুরাগী বলেন, বই নিয়েই কেটে যায় আমার দিন-রাত। নিজ এলাকায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বইপ্রেমীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন সেলুনেও বই দিয়ে রেখেছি। সেলুনে চুল কাটাতে এসে অনেকেই সেসব বই পড়ে। নিজের ভেতর ভিন্ন এক ভালোলাগা কাজ করে।
বইয়ের প্রতি সেই ভালোবাসা আমাকে টেনে এনেছে এ উৎসবে। আর সমাজকে বদলাতে হলে বইয়ের বিকল্প নেই। সে কারণেই বই বিনিময়ের এ আয়োজনটির রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে উৎসব আঙিনায় ঘুরছিলেন চিত্রশিল্পী ও চারুকলার শিক্ষক অধ্যাপক মলয় বালা। আলাপচারিতায় জানালেন, নিজের অনেক বই অপরকে দিয়েছেন এবং নিজেও কিছু বই সংগ্রহ করেছেন। আয়োজনটির মূল্যায়নে তিনি বলেনÑফল উৎসব, পিঠা উৎসবসহ কত রকমের উৎসব আমরা হতে দেখি।
আমরা সেই উৎসবে দলবেঁধে যাই। টাকা দিয়ে ফল কিনি বা পিঠা কিনি। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে খাই। এরপর বাসায় ফিরে আসি। অতঃপর সব শেষ। কিন্তু উৎসবটা যদি হয় বিনিময়ের এবং বিনিময়ের সেই বস্তু যদি হয় বই; তাহলে উৎসব ফুরিয়ে গেলেও বইখানা আপনার কাছে চিরকাল রয়ে যাবে। আপনি পড়বেন, আপনার সন্তানরা পড়বে এমনকি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সেই বইটি পড়বে। কখনোবা একটা বই মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। তাই এই বই বিনিময় উৎসব আমার কাছে প্রাণের উৎসব।
এখানে আড্ডা হয় বই নিয়ে। গল্প হয় আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে ঘিরে। এখানে আমরা একে অপরকে জানতে পরি। সুখ-দুঃখের খবর নিতে পারি। ফেরার পথে উপহার হিসেবে সঙ্গে থাকে বন্ধুর দেওয়া একটি বই। এর চেয়ে সুন্দর উৎসব আর কী হতে পারে!