ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুষ্টচক্রের কব্জায় স্বাস্থ্য বিভাগ

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১১ মে ২০১৯

 দুষ্টচক্রের কব্জায় স্বাস্থ্য বিভাগ

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ সংঘবদ্ধ দুষ্ট চক্রের কব্জায় এখন ময়মনসিংহের স্বাস্থ্য বিভাগ। নানা অনিয়ম, দুর্নীত ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী এই চক্রটি বদলি বাণিজ্য, পদায়ন ও সরকারী অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এর ভাগ যাচ্ছে ওপর মহলেও! ফলে তদন্তে প্রমাণিত জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতে জড়িত চক্রটি বরাবরই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। উল্টো তিরস্কারের বদলে পুরস্কৃত হচ্ছে দুষ্ট চক্রের সদস্যরা। প্রশাসনিকসহ দুর্নীতির কারণে অন্যত্র বদলি হওয়া এসব কুশীলবদের ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে এসবের নেপথ্যে লেনদেন হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে নান্দাইল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একাধিক কর্মচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, জহিরুলের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগে বদলির পর ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ে পদায়ন রহস্যজনক। স্বাচীপের স্থানীয় নেতৃবৃন্দও এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি পরায়ণ স্থানীয় এক শীর্ষ কর্মকর্তা ও তার তল্পিবাহক কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী যোগসাজশ করেই ময়মনসিংহের স্বাস্থ্য বিভাগকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ স্বাস্থ্য বিভাগের নিরীহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীর নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ সরকারী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তারা খতিয়ে দেখছেন। জানতে চাইলে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক বিএনপি পন্থী ডাঃ আবুল কাসেম জানান, একটি মহল তাকে মেনে নিতে পারছে না বলেই নানা অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। তবে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মজিবুর রহমানকে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে প্রশাসনিক কারণে অন্যত্র বদলির পর ময়মনসিংহ সদরে নিয়ে আসা ও নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক ক্যাশিয়ার জহিরুল ইসলাম ভুঞাকে ঘুষ দুর্নীতিসহ সরকারী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে তাকে অন্যত্র বদলি হওয়ার পর ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, এসব বিষয় তাঁর জানা ছিল না। চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান অবস্থায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে প্রত্যাশিত কর্মস্থলে বদলির করে বিতর্কিত হন ডাঃ আবুল কাসেম। এই বদলির ঘটনায় মন্ত্রণালয় কারণ দর্শাও নোটিস দিয়েছে পরিচালক ডাঃ আবুল কাসেমকে। স্বাচীপ-ময়মনসিংহের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মতিউর রহমান ভুইয়া জানান, স্বাচীপের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও সব সময় সুবিধা নিয়েছেন বিএনপি পন্থী এই পরিচালক। স্থানীয় সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে নানা কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে বদলি হয়ে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই বদলি ও পদায়নসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে ডাঃ আবুল কাসেমের বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক ফার্মাসিস্ট আমিনা খাতুন গত ২০১৩ সালে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশ চলে যান। অভিযোগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক ক্যাশিয়ার জহিরুল ইসলাম ভুঞা ফার্মাসিস্ট আমিনা খাতুনের গত ২০১৩ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসের বেতন ও দুইটি উৎসব বোনাসের টাকা তুলে আত্মসাত করেন। থলের বেড়াল বের হওয়ার আশঙ্কায় আমিনার ফাইলটিও এ সময় অফিস থেকে গায়েব করে ফেলা হয়। এ সময় নান্দাইল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বে থাকা ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের বর্তমান পরিচালক ডাঃ আবুল কাসেম জানান, অফিস সহকারী আফরোজার হেফাজতেই ছিল আমিনার ফাইলটি। বিষয়টি জানাজানি হলে পরবর্তীতে আলাদা দুইটি চালানের মাধ্যমে জহিরুল ইসলাম এই টাকা গত ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে সরকারী কোষাগারে জমা দেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের চিত্ত বিনোদনের ভাতা আত্মসাতসহ তাদের বেতন ভাতার বিল প্রদানের সময় কমিশন নেয়ার অভিযোগ রয়েছে জহিরুলের বিরুদ্ধে। বেতন বিলে কর্মচারী দেলোয়ারা খাতুনের দুই মাসের আগাম স্বাক্ষর নিলেও পরে তার বেতন ভাতাদি না দিয়ে আত্মসাত করেন জহিরুল ইসলাম। এভাবে জহিরুল ইসলাম ভুঞা এখন অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন। এসব নানা অভিযোগ স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে মাঠ কর্মচারীদের মাসিক সভায় তুলে ধরা হলে তদন্তের নির্দেশ দেন আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহীন এমপি। ঘুষ দুর্নীতি ও সরকারী অর্থ আত্মসাতের এসব নানা অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে জহিরুল ইসলামকে নান্দাইল থেকে অন্যত্র বদলির প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু পরিচালক ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদুল হক কারসাজি করে জহিরুলকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে নিয়ে আসে। সর্বশেষ ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডাঃ আবুল কাসেম যোগদানের পর বিতর্কিত এই ক্যাশিয়ার জহিরুল ইসলামকে তার নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসায় নানা গুঞ্জন উঠেছে। প্রচার রয়েছে, ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের সব অনিয়ম জায়েজ করতেই জহিরুলকে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে এসেছেন ডাঃ আবুল কাসেম। নান্দাইল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক মেডিক্যাল অফিসার (এমও), আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ আবুল কাসেমের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ছিলেন এই জহিরুল ইসলাম ভুঞা। এ সময়েই জহিরুলের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। জহিরুল ইসলাম ভুঞার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির একটি সূত্র জানায়, তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর প্রশাসনিক কারণে বদলি করা একজন কর্মচারীকে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের কার্যালয়ে পদায়ন নজীরবিহীন। স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ রাশেদুল ইসলাম স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। বিষয়টি গোপন রেখে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মজিবুর রহমান সুবিধা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগ বিষয়টি জানতে চাইলে মজিবুর রহমান ত্রিশাল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন চিকিৎসক অনুপস্থিত নেই বলে জানায়। এ সময় ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ছিলেন ডাঃ মাহবুবুর রহমান। পরবর্তীতে ডাঃ রাশেদুল যোগদান করতে এলে ঘটনা জানাজানি হয়। শেষ পর্যন্ত ডাঃ রাশেদুল যোগদান করতে পারেননি। সূত্র জানায়, ওই সময়ে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী ভর্তি ছিল ১১ জন। অথচ খাবারের জন্য প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৩১ জনের। অতিরিক্ত রোগী দেখিয়ে ঠিকাদারের বিল পরিশোধে মজিবুর রহমানের কারসাজি ছিল বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। সর্বশেষ অফিসের আলমিরা ভেঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা চুরির নাটক সাজিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ উঠে মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। অভিযোগ চুরি যাওয়া পাঁচ লাখ টাকা সমন্বয়ের কথা বলে মজিবুর রহমান সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন। প্রথম দিকে স্টোর কিপার আমিনুল ইসলামের কাছে চাঁদার টাকা জমা রাখা হয়। এসব অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে প্রশাসনিক কারণে ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। এসময় অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভুল বুঝিয়ে বদলির আদেশ বাতিলের আবেদনে স্বাক্ষর আদায় করে মজিবুর রহমান। এসব নানা ঘটনায় বিতর্কিত ও দুর্নীতি পরায়ণ এই মজিবুর রহমানকে নিজ কার্যালয়ে বদলি করে আনেন পরিচালক ডাঃ আবুল কাসেম। জহিরুল ইসলাম ও মজিবুর রহমানের নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক জানান, কাজের সুবিধার জন্যই তাদের প্রেষণে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে এসেছেন। জহিরুল ইসলাম ও মজিবুর রহমানসহ একাধিক দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা কর্মচারীকে একদিকে পরিচালকের কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিচালকের কার্যালয় থেকে হিসাব রক্ষক হেনজেলা মিয়া, ফারুক আলম ও সায়েমসহ একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদুল হককেও পরিচালকের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে প্রচার রয়েছে। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক এক পরিচালক জানান, বদলি বাণিজ্যসহ বেপরোয়া ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর হওয়ায় ফরিদুল হককে পরিচালকের কার্যালয় থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রচার রয়েছে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের ক্ষমতাধর শীর্ষ কর্মকর্তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিরাতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফরিদুল হকের বাসায় জহিরুল ইসলাম ও মজিবুর রহমানসহ দুষ্টচক্রের কুশীলবদের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে।
×