ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য কখনও মাকে দায়ী করবেন না

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ৩ এপ্রিল ২০১৯

প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য কখনও মাকে দায়ী করবেন না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি সন্তান প্রতিবন্ধী হলে অযথা মাকে দোষারোপ না করতেও দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, একটা শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে যে অটিস্টিক হবে, প্রতিবন্ধী হবে তা ওইভাবে জানা থাকে না। এই ধরনের শিশু জন্মদানের জন্য মাও দায়ী থাকেন না, বাবাও দায়ী থাকেন না। কেউই কিন্তু দায়ী থাকেন না। সাধারণ মানুষের মতো না হওয়া এটা আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা। দেশের সব বিভাগীয় শহরে অটিজম পরিচর্যা কেন্দ্র করার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার আগামী বাজেট থেকে দেশের ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী শিশুকে বিশেষ ভাতার আওতায় আনা হবে। তবে অনেক সময় দেখি, বাবা-মা বিশেষ করে মায়ের ওপর অনেক দোষারোপ করা হয়। আশা করি ভবিষ্যতে কেউ আর মাকে অযথা দোষারোপ করবেন না। এটা মায়েরও কষ্ট। আল্লাহ একটা মানুষকে এভাবে তৈরি করেছেন- তাকে তো অবহেলা করা কোন সুস্থ মানুষের কাজ নয়। আমরা মানবতার কথা বলি, মানবাধিকারের কথা বলি, অনেক কিছু বলি কিন্তু এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। ছোট্ট বেলা থেকে আমরা শিখেছি কানাকে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না। সেই শিক্ষা স্কুলেও দেয়া উচিত। দ্বাদশ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জোয়েনা আজিজ। অটিজম আক্রান্তদের পক্ষে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী অনুভূতি ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অটিজম আক্রান্ত ৫ শিশুকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং অটিজম সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিন ব্যক্তিত্ব এবং তিন প্রতিষ্ঠানকেও পুরস্কৃত করেন। তিনি অনুষ্ঠানে নীল বাতিও প্রজ্বালন করেন। অটিস্টিক শিশুদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২ এপ্রিলকে বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার।’ প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বলেন, আমি এইটুকুই চাইব, এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী যেন আর অবহেলার শিকার না হয়। তারা যেন আমাদের সমাজে তাদের যোগ্য স্থান পায়। তারা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই ভাই, বোন। সে কথাটা মনে করে সবাই অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে নিয়ে চলবেন সেটাই আমি চাচ্ছি। তিনি বলেন, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সুস্থ পরিচর্যা পেলে স্বাভাবিকভাবে জীবনে সকলের সঙ্গে মিলে চলতে পারবে। অটিজম আক্রান্ত শিশুরা কোন একটি বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদের মাঝে যে সুপ্ত জ্ঞান এবং প্রতিভা থাকে, সেটাকেও কাজে লাগাতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের মেধাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাদের আপনারা যদি একটু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে তাদের জীবনটাও অর্থবহ হয়। তারা যতটুকু সুযোগ পায় সেটাকে কাজে লাগাতে পারে। প্রতিবন্ধীদের জন্য তার সরকার এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় আধাঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা যতটা সময় পায় তার থেকে প্রতিবন্ধীরা একটু বেশি সময় পায় এই জন্য যে, তারা যেন পরীক্ষাটা ঠিকমতো দিতে পারে। কারণ তারা অন্য সবার মতো একইসঙ্গে লিখে শেষ করতে পারে না। তিনি বলেন, এখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। আগে যেমন এ ধরনের বাচ্চা হলে অনেকে লুকিয়ে রাখত। এখন আর লুকিয়ে রাখে না। এটা আমাদের সমাজে খুব বেশি প্রয়োজন। তারপরও এদের দেখাশোনা করা বেশ কষ্টকর। সবাই সহানুভূতিশীল হবেন এটাই প্রত্যাশা। মানুষ যেন কখনও এটা না ভাবে যে অটিজম প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা। বরং আমরা মনে করি তাদেরও অধিকার আছে। সেই অধিকার আমাদের সুরক্ষিত করতে হবে। যারা সুস্থ ব্যক্তি তাদের উপরই এ দায়িত্ব বর্তায়। দেশের সব বিভাগে অটিজম পরিচর্যা কেন্দ্র করার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পিতামাতা ও অভিভাবকহীন নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বগুড়ায় ৫০ আসনের পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পর্যায়ক্রমে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে বৃহৎ পরিসরে এ ধরনের পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এসব কেন্দ্রে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা, খেলাধুলাসহ সকল সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে যখন সম্ভব হয় আমরা প্রতি জেলায় করে দেব। কারণ অনেক বাবা-মা আছেন, তাদের ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা থাকে যে তারা না থাকলে এই বাচ্চাদের কে দেখবে। যাদের ভাই-বোন আছে, যারা ভাল সহানুভূতিশীল তারা তো দেখে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো তা হয় না। বাবা-মার সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যই আমরা এই বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা পরিচর্যা কেন্দ্র করে দেব। আমরা যে ট্রাস্ট ফান্ড করে দিয়েছি তার মাধ্যমে সহায়তা দেব। ট্রাস্ট ফান্ডে অনুদান দিতে প্রধানমন্ত্রী বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব থেকে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো একটা শিশু অটিস্টিক, কী কী অবস্থা হলে সেটা ধরা পড়বে সেটা জানা। পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে আচরণ করতে হবে, কিভাবে কথা বলতে হবে, কি কাজ করলে সে আরও সুস্থতার দিকে যাবে এর উপরে একটা ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। সেটা আমাদের দেশে খুব বেশি একটা নেই। যে কারণে আমি আমার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদকে দিয়ে সূচনা ফাউন্ডেশন তৈরি করেছি। সে ফাউন্ডেশনে আমরা নিজেরাও কিছু অনুদান দিয়েছি। অনেকেই সেখানে অনুদান দিয়েছেন। খুব সীমিত আকারে এই ধরনের শিক্ষক, গার্জিয়ান তাদেরকে ট্রেনিং দেয়া এবং কী কী ভাবে এগুলো করতে হবে সেই ব্যবস্থা করছি। অটিস্টিক এবং প্রতিবন্ধীরাও যে সাধারণ মানুষের মতো সবকিছু করতে পারে সে প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই যারা অটিস্টিক বা প্রতিবন্ধী তারা যেন সমাজের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। তাদের যেন কেউ বোঝা মনে না করে। তাদের মাঝে কিন্তু অনেক ট্যালেন্ট আছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কাউকে একটি পানির বোতল এনে দিতে বলেন। অনুষ্ঠানে পান করতে দেয়া বোতলজাত ‘মুক্তা’ পানির বোতল হাতে নিয়ে তিনি বলেন, এই পানিটা কারা তৈরি করে আপনারা জানেন? এটা কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তৈরি করে। দুর্ভাগ্য হলো আমার অফিসেও বলে এই পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আমি যখন বলি আমার জন্য হয়তো অন্য ব্র্যান্ডের পানি যথেষ্ট নিয়ে আসে। এটা যেহেতু আমাদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা করে এর বোতলগুলো উন্নতমানের করা, ছোট ছোট বোতল করা- সেগুলো আমরা করে দিয়েছি। কিন্তু এটাকে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে কারও কারও আন্তরিকতার একটু অভাব দেখি। আমার অফিসের সবাই আছে এখানে। আমি আশা করি আজকের দিনের পরে এই পানি নেবেন। প্রধানমন্ত্রী এ কথায় মিলনায়তনের সবাই করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রতিবন্ধীদের বহুমুখী প্রতিভার উদাহরণ দিয়ে বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা প্লাস্টিক এবং বেত দিয়ে মোড়া তৈরি করছে, নানা সাংসারিক উপকরণ তৈরি করছে। আমি সুযোগ পেলেই এসব সংগ্রহ করি এবং ব্যবহার করি। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর দুই ঈদ এবং নববর্ষের জন্য যে সব শুভেচ্ছা কার্ড পাঠান সেগুলো প্রতিবন্ধীদের চিত্রাঙ্কন থেকেই নির্ধারিত মূল্য দিয়ে সংগ্রহ করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, প্রতিবন্ধীদের এই চিত্রাঙ্কন থেকে তৈরি কার্ড দিয়ে তার মেয়ে এবং বিশ্ব অটিজম আন্দোলনের অগ্রপথিক সায়মা ওয়াজেদ হোসেন একটি এ্যালবাম তৈরি করেছেন। যেটি তার সরকার উপহার স্বরূপও বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সমাজকল্যাণ পরিদফতরের মাধ্যমে দেশের ৪৭টি সাধারণ বিদ্যালয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমন্বিত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। সে সময়ের বাস্তবতায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মূলধারার বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম ছিল প্রগতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর একটি পদক্ষেপ। তিনি বলেন, তার সরকার ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ এবং ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩’ আইন পাস করেছে। এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় বিধিও প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট’। সরকার প্রধান বলেন, এ পর্যন্ত সরকার এই ট্রাস্টকে ৭০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। ট্রাস্ট থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮১১ অস্বচ্ছল নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ৪০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১২০০ জনকে ৭০ লাখ টাকা সহায়তা দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ১০ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মাসিক ৭০০ টাকা হারে ভাতা এবং ৯০ হাজার অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীকে মাসিক ৭০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা হারে শিক্ষা উপবৃত্তি দিচ্ছে।
×