ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিডনি সংযোজন ॥ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ১২:১৭, ২ এপ্রিল ২০১৯

কিডনি সংযোজন ॥ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে কিডনি সংযোজন একটি প্রধান সাফল্য। সংযোজিত কিডনি নিয়ে আজকের দুনিয়ায় মানুষ বছরের পর বছর বেঁচে আছেন এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। একজন মানুষের কিডনি অন্য একজনের শরীরে সংযোজন করাকে কিডনি সংযোজন বলা হয়। কিডনি সংযোজন সাধারণত দু’ভাবে করা যায়-মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন এবং নিকট আত্মীয়ের যে কোন একটি কিডনি নিয়ে সংযোজন করা। আমাদের দেশে বর্তমানে জীবিত নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজিত (Live related kindey transplantation) নিয়মিত হচ্ছে এবং এর সাফল্যও উন্নত বিশ্বের যে কোন দেশের সমান। কিডনি সংযোজনের জন্য প্রস্তুতি (জীবিত বা Live related) ঃ কোন রোগীর দুটো কিডনি সম্পূর্ণরূপে আকেজো হয়ে গেলে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রথম প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট, সনোগ্রাম করে কিডনী অবস্থান ও সাইজ দেখা, এঋজ বা ঈঈজ ইত্যাদি পরীক্ষা করে কিডনি অকেজো রোগ নির্ণয় করা হয়। কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো জানার পরই ডায়ালাইসিস করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দু’ধরনের ডায়ালাইসিস বিদ্যমান রয়েছে- পেরিটোনিয়েল ডায়ালাইসিস ও হিমোডায়ালাইসিস। তবে হিমোডায়পলাইসিস শুরু করার পূর্বে সাধারণত বাম হাতের কব্জির উপরে একটি A-V Fistula তৈরি করে নেয়া হয় যা গধঃঁৎব হতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। হিমোডায়ালাইসিস বা মেশিনের পাশাপাশি রোগীকে ও তাঁর নিকট পরিজনকে রোগ সম্পর্কে ধারণা, চিকিৎসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সুযোগ-সুবিধা এবং আর্থিক দিক সম্পর্কেও সম্যক ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। একজন রোগীকে সবদিক বিবেচনা করে যখন কিডনি সংযোজন প্রোগ্রামে মনোনীত বা ঝবষবপঃরড়হ করা হয় তখন সেই রোগীকে কিডনি সংযোজনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির কিডনি সংযোজন ও প্রস্তুতি (Cadaveric Kidney Transplantation) মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে অন্য রোগীকে সংযোজন করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। বর্তমান উন্নত বিশ্বে যেমন-ইউরোপ/আমেরিকার মতো দেশে এর সুব্যবস্থা রয়েছে এবং শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ কিডনি সংযোজন মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে করা হয়ে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ইনস্টিটিউট’ এবং পাকিস্তানের “SIUT (Sindu Institute of Urology & Transplanatation)” – এ সম্প্রতি ঈধফধাবৎরপ বা মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন শুরু হয়েছে। উন্নত দেশে যারা মৃত্যুর পরে কিডনি দান করতে চান তারা জীবিত কালেই তা দান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং কিডনি ডোনার কার্ড সঙ্গে রাখেন। এই সমস্ত কিডনি ডোনার যদি হঠাৎ কোন যান্ত্রিক দুর্ঘটনা বা স্টোকে মৃত্যুর দিকে পতিত হন, তখন তাদেরকে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করা হয়। উন্নত ধরনের সকল চিকিৎসা প্রয়োগ করেও যখন দেখা যায় এদের বাঁচানো সম্ভব নয় তখন দু’জন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ (Neurologist) রোগীকে পরীক্ষা করেন। এই বিশেষজ্ঞদয় কিডনি সংযোজন প্রোগামের সহিত জড়িত থাকেন না এবং পৃথকভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন ও Brain death অর্থাৎ জ্ঞান ফিরবার আর কোন সম্ভাবনা নেই এই সনদপত্র দেওয়ার পরই কিডনি নেবার ব্যবস্থা করা হয় এদের কিডনি, হৃদপি-, ফুসফুস ইত্যাদি জীবন রক্ষাকারী মেশিনের দ্বারা কার্যক্ষম রাখা হয়। এই অবস্থায় এদের রক্তের গ্রুপ, ঐখঅ টাইপিং ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে নেওয়া হয় এবং এর ফলাফল কম্পিউটার প্রোগ্রামে দেওয়া হয়। যে সমস্ত রোগী কিডনি সংযোজনের অপেক্ষায় আছেন তাঁদের সবার তালিকাও ঐ সমস্ত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক প্রোগ্রামে রয়েছে, এরা সবাই ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে বেঁচে আছেন এবং তাদের সকলের রক্তের গ্রুপ, টিস্যু টাইপসহ অন্যান্য পরীক্ষার রিপোর্ট কম্পিউটারে জমা রাখা হয়। কম্পিউটারের মাধ্যমেই মৃতপ্রায় কিডনি ডোনারের রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপসহ অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে কিডনি অকেজো কিন্তু ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে চিকিৎসারত ও কিডনি সংযোজনের জন্য অপেক্ষারত রোগীদের মিল খুঁজে বের করা হয় এবং সম্ভাব্য সংযোজিত কিডনি রোগীদের নাম জেনে নেওয়া হয়। তখন সম্ভাব্য সেই রোগীকে কিডনি সংযোজনের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। এই অবস্থায়ও নির্ধারিত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে বরফের ভিতর রেখে ৩-৬ ঘণ্টার মধ্যে সম্ভাব্য রোগীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং কিডনি সংযোজনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এ ধরনের কিডনি সংযোজনকে মৃত ব্যক্তি কিডনি নিয়ে সংযোজন বলা হয়ে থাকে। জীবিত নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন (Live Related Kindey Transplantation) ডোনার হিসেবে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার কোন নিকট আত্মীয় যার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে তাঁকে একটি কিডনি দান করতে পারেন এবং এই কিডনি সংযোজনকে জীবিত নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন বা (Live Related Kindey Transplantation) বলা হয়। আত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করা আইন ও নীতিগতভাবে ঠিক নয় এবং তারা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। জীবিত নিকট আত্মীয় বলতে বাবা-মা, ছেলে মেয়ে ও ভাই বোনদের মধ্যে বোঝায়। কিডনি দেবার পূর্বেই এদের রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপ করিয়ে নেয়া হয়। যখন দেখা যায় কোন আত্মীয় ডোনারের সঙ্গে রোগীর মিল আছে তখন আত্মীয় কিডনি দাতার সব রকম পরীক্ষা করা হয়। কিডনি দাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছর অর্থাৎ অমব ড়ভ পড়হংবহঃ এর ওপর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত। কিডনি দাতার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দু’টো কিডনিই সম্পূর্ণ ভাল থাকতে হবে। কিডনি দাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে হবে, জোর জবরদস্তি করা চলবে না। কিডনি দাতার পরীক্ষা করে সবকিছু নিরাপদ জেনেই তার একটি কিডনি নেয়া হয় এবং একটি কিডনি নিয়েই স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন যাপন করা যায়। যার ফলে একজন জীবিত সুস্থ কিডনি দাতা তার একটি কিডনি দান করেও নিজে সুস্থ থাকেন এবং কিডনি অকেজো একজন রোগী তার একটি কিডনি সাফল্যজনকভাবে সংযোজন করে নিয়ে পুনরায় সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় কিডনি দান কারার দরুন স্বাস্থ্যের ওপর কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয় না বা জীবনের আয়ুও কমে না। উপরন্তু কিডনি দান করার দরুন তার মানবিক গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সম্পর্ক গভীর হয় ও আত্মীয়স্বজনের নিকট মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনে বর্তমান প্রেক্ষাপট বর্তমানে আমাদের দেশে শুধুমাত্র খরাব জবষধঃবফ করহফবু ঞৎধহংঢ়ষধহঃধঃরড়হ বা জীবিত নিকট আত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন হচ্ছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয/পি.জি হাসপাতালে ঘবঢ়যৎড়ষড়মু, টৎড়ষড়মু ও অহধবংঃযবংরড়ষড়মু বিভাগের সমন্বয়ে প্রতি সপ্তাহে একটি করে কিডনি সংযোজন চলছে। ইহা ছাড়াও কিডনি ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি (ঘওকউট), ইওজউঊগ হাসপাতাল এবং সম্প্রতি ইউনাইটেড হাসপাতাল এ নিয়মিতভাবে কিডনি সংযোজন চলছে। এ পর্যন্ত (জানুয়ারি ২০১৭) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০৫টি কিডনি সংযোজন হয়েছে। এদের সাফল্যও সন্তোষজনক, যা উন্নত বিশ্বের সাফল্যের সমমানের দাবি রাখে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এদের কিডনি দাতাগণ সবাই ভাল আছেন ও সুস্থ জীবন যাপন করছেন। অতি শীঘ্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্বদ্যিালয়ে কিডনী ও ইউরোলজী বিভাগের সম্প্রসারণ শুরু হবে, ইহাতে কিডনী রোগীদের কিডনি সংযোজনসহ হেমোডায়ালাইসিস ও অন্যান্য চিকিৎসার আরও ব্যাপক বিস্তার পাবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়াও কিডনি ফাউন্ডেশনের উদ্দোগে মিরপুরে বৃহদাকারে কিডনি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্প্রতি চালু হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা (ডায়ালাইসিস কিডনি সংযোজন, টিস্যু টাইপিং) সহ সকল কিডনি রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে স্বল্প সংখ্যক কিডনি সংযোজনের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে নিকট আত্মীয় কিডনি দাতার স্বল্পতা। কাজেই কিডনি দাতার স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে হলে ঈধফধাবৎরপ শরফহবু ঞৎধহংঢ়ধষধহঃধঃরড়হ (মৃত ব্যক্তির কিডনির) ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য দরকার কিডনি রোগ সম্বন্ধে সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা ও গড়ঃরাধঃরড়হ এর প্রয়োজন, যার জন্য সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেনাল এ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক কিডনি ডোনার কার্ডের প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আমরাও আশা করব আগামী ২০২০ ইং সাল নাগাদ আমাদের দেশে কিডনি সংযোজনের হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং কিডনি অকেজো রোগীদের দেশের বাইরে কিডনি সংযোজনের জন্য যাওয়ার প্রবণতাও অনেকাংশে কমে যাবে। যার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল ইসলাম সেলিম এমবিবিএস, এমসিপিএস (মেডিসিন), এমডি (নেফ্রোলজি) ফেলো ইন নেফ্রোলজি (ইউকে) এফএসিপি, এফএএসএন (ইউএসএ), এফআরসিপি (ইউকে) চেয়ারম্যান, নেফ্রোলজি বিভাগ বিএসএমএমইউ, শাহবাগ, ঢাকা
×