ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন কণ্ঠযোদ্ধা শাহনাজ রহমতুল্লাহ

প্রকাশিত: ১০:০৭, ২৯ মার্চ ২০১৯

 চলে গেলেন কণ্ঠযোদ্ধা  শাহনাজ রহমতুল্লাহ

কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ চিরতরে চলে গেলেন অগণিত ভক্তকে শোকে বিহ্বল করে। এমন শোক অর শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। সুরেলা কণ্ঠের জাদুকরী স্পর্শে প্রায়ই অর্ধশত বছর দর্শক-শ্রোতা মাতানো এই অপরাজেয় শিল্পী যে মাত্রায় সঙ্গীতের ভান্ডারকে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন তাকে কণ্ঠ জগতের মহানায়িকা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কোন উপায় নেই। গলার মিষ্টি সুরদ্যোতনা যেভাবে দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ের গভীরে স্পর্শকাতর অনুভবে আলো ছড়ায় সেই আলোকিত জীবন আজ অন্ধকারের গহীন বিবরে ঢাকা পড়ল। এই মহান কণ্ঠশিল্পীর গান শুনতে শুনতে বড় হওয়া অনেকের হৃদয়ে তার জায়গা কতখানি ছিল সে সত্য তিনি নিজেই কি জানতেন? একসময় তার সমৃদ্ধ সঙ্গীত পরিক্রমায় গানের ভুবনকে মাতানো অবিস্মরণীয় শৈল্পিকসত্তা ভক্তদের যে মাত্রায় আবেগে বিহ্বল করে দিত বেঁচে থাকতেই সেই কণ্ঠ হঠাৎ কেন জানি না স্তব্ধ হয়ে গেল। তার পরেও তার কালজয়ী গানগুলো কাল থেকে কালান্তরেই শুধু নয় কয়েক প্রজন্ম ধরে যেভাবে আন্দোলিত করে যাচ্ছে এখনও সেখানেই তার কণ্ঠ অম্লান আর চিরকালের। তিনি শুধু দেশের নন অন্য প্রান্তেও তার অদ্ভুত শৈল্পিক কণ্ঠশৌর্য যে পরিমাণ ভক্ত- শ্রোতার মর্মমূল সুরের মূর্ছনায় ভরিয়ে তোলে সে মাত্রায় তার নিবেদিত সৃজনবোধ এক বিশিষ্ট স্থানে চিরস্থায়ী আসন তৈরি করে। বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত গীতিকারদের কথা কণ্ঠে ধারণ করে তিনি সুরের শিল্পিত ধারাকে যেভাবে দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ের নিভৃতে পৌঁছে দিতেন সেখানে বোধহয় তিনি নিজেই তার তুলনা। একজন নিবেদিত সাংস্কৃতিক যোদ্ধা কিংবা সৃজনব্যক্তিত্ব মাতৃভূমি আর ভাষাকে যেভাবে আদর্শিক বোধে লালন করেন সেখানে এই বরেণ্য শিল্পীর অন্য কোন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা অসম্ভব। দেশাত্ববোধের অকৃত্রিম মমতায় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ কিংবা ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ কখনও ‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’কে সাবলীল কণ্ঠশক্তিতে অনন্য করে তোলেন তা কোন কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। আর ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’ গানটি ভক্তদের হৃদয় কাঁপানো অনুভবে নিজেকে যে মাত্রায় বিলিয়ে দিয়েছেন মনে হচ্ছে সেই নান্দনিক চেতনায় সীমা থেকে অসীমের পানেও সমর্পিত হলেন। শিল্পীদের আসলে কোন দেশ নেই কাল নেই, সীমা-পরিসীমার কোন রেখাও থাকতে পারে না। তিনি সব কালের, সব দেশের এমনকি সর্বমানুষেরও। যাকে তিনি নিজেই সব সময় অতিক্রম করে যান। আর তাই শাহনাজ রহমতুল্লাহর মতো এমন সুরের সাগরে সাঁতরে বেড়ানো সৃজনের কোন নির্দিষ্ট সীমাও নেই। এই সঙ্গীত সাধকের অনবদ্য কণ্ঠের ছোঁয়ায় যেসব গান দর্শক এবং শ্রোতা নন্দিত হয়েছে তা আবার শ্রেষ্ঠ বাংলা গান বাছাইয়ে অনবদ্য জায়গাও করে নেয়। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের মধ্যে এই যুগশ্রেষ্টা সঙ্গীতশিল্পীর ৪টি গান আপন বৈশিষ্ট্যে জায়গা করে নিতে সময় লাগেনি। তাই অনন্ত যাত্রায় কোন প্রতিভাবান শিল্পীর গুণ এবং নান্দনিকতার কদর কমে না বরং বেড়েই যায়। যার অনুপস্থিতিই আমাদের মনে করিয়ে দেবে সুরের আকাশে তার অবিস্মরণীয় ভেসে বেড়ানো, দেশ, মাটি আর মানুষকে যিনি তার নান্দনিক দ্যোতনায় সমৃদ্ধ করেছেন তারাই তাকে চিরস্থায়িত্বের মর্যাদা দেবে। সম্মান আর শৈল্পিকসত্তায় একাকার হয়ে যাওয়া এমন ব্যক্তিত্ব মানুষের হৃদয়কে সব সময় আলোড়িত করবে। দেশ ও মানুষই কোন সৃজন ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তার মাঝেই তিনি বেঁচে থাকতে চান, যুগ যুগ ধরে তাদের প্রাণিত করতে বার বার ফিরতেও চান। যে চাওয়া তাঁকে সময় এবং যুগকে অতিক্রম করে আকাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে দিতেও সময় লাগবে না। মরণ তাকে তার অনুরাগীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে না। আরও বেশি করে তিনি জেগে উঠবেন আধুনিক ও নতুন প্রজন্মকে সঙ্গীতাঙ্গানের সুস্থ ধারায় সম্পৃক্ত করতে। জনপ্রিয় গজল শিল্পী মেহেদি হাসানের প্রিয় শিষ্য শাহনাজ রহমতুল্লাহ উর্দু ভাষায় পারদর্শী হওয়াতে এমন কণ্ঠসৈনিকের তালিম নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার পরেও বাংলা গানই ছিল তার কণ্ঠের অন্যতম বৈভব। যেখানেই তিনি যান না কেন চিরশান্তিতে তাঁর আত্মা নিশ্চিন্তে অনন্তকাল পার করুক এটাই তার ভক্ত-শ্রোতাদের শুভ কামানা। স্বাধীনতার মাসে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ সম্মিলিত গানের অন্যতম কণ্ঠসৈনিক শাহনাজ রহমতুল্লাহকে হারানো সত্যিই মহিমান্বিত এই সময়টিকে শোকাভিভূত করে দিল।
×