ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা অপর্যাপ্ত অবকাঠামোয় ব্যাহত হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:২৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা অপর্যাপ্ত অবকাঠামোয় ব্যাহত হচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ বাংলাদেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিক্যাল উপকরণের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। তাই দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসার অবকাঠামো আরও মজবুত করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ লোক নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর বছরে মারা যায় প্রায় দেড় লাখ রোগী। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে বছরে ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসা গেলেও আড়ালে থেকে যায় আরও প্রায় আড়াই লাখ রোগী। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, জনসংখ্যার অনুপাতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সুবিধা সংবলিত ১৬০ ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা আছে মাত্র ১৫। আবার এর সবগুলো কার্যকরও নয়, বেশির ভাগই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। এছাড়া সারাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ৮৫। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। সচেতনতার অভাব ও চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক ক্যান্সার রোগী অকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য পরিবার। দুই বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন ফেনীর মোঃ মোজাম্মেল (৩৬)। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ঢাকার একটি সরকারী হাসপাতালে দুই বছর ধরেই তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। মোজাম্মেলের সঙ্গে হাসপাতালে আসা তার এক আত্মীয় বলছিলেন প্রথমে তারা ভারতে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও চিকিৎসার খরচের কথা চিন্তা করে দেশের সরকারী হাসপাতালেই চিকিৎসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। মোঃ মোজাম্মেল জনকণ্ঠকে জানান, কুমিল্লা থেকে ঢাকা এসেছি। এখানকার ডাক্তাররা বলল, বাংলাদেশে চিকিৎসা আছে। তাই খরচের কথা ভেবে ভারতে যাইনি। কিন্তু এখানেও অনেক খরচ। এই রোগের চিকিৎসার একটি অংশ কেমোথেরাপি, যেটা মোজাম্মেলকে দেয়া হয়েছে ১২টি। আর প্রতিবারেই এ বাবদ তাদের গুনতে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। তার এক আত্মীয় বলছিলেন জমি, গবাদিপশু বেচে ও অন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে চলছে তার চিকিৎসা। মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালের তেমনি একটি বিভাগে কেমোথেরাপি নিতে কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন ফিরোজ মিয়া (৪৭)। তার সঙ্গে রয়েছে ছেলে ফয়েজ মিয়া (১৮)। সে জনকণ্ঠকে জানায়, ডাক্তার ১০টি কেমোথেরাপি নেয়ার কথা বললেও আপাতত ৬টার বেশির খরচ বহন করা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। ফারজানা আক্তার, শেরপুর জেলা সদরের নয়াপাড়া লসমানপুর গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মেয়ে। বয়স মাত্র ৫ বছর। সে দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। বর্তমানে সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাঃ আফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছে। চিকিৎসার পেছনে সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন শিশুটির পিতা মোঃ ফারুক হোসেন। দুই বছর আগে ক্যান্সার ধরা পড়ে তার। সেই থেকে টানা চিকিৎসা চলছে। ফারজানা সুস্থ হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েও চিকিৎসকদের এমন কথা বাড়িয়ে দিয়েছে শিশুটির মাতা-পিতার কষ্টের মাত্রা। সাত বছরের শিশু ইয়ামিন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। শুধু বোনমেরো ট্রান্সপ্লান্ট করালেই বাঁচানো যাবে ইয়ামিনকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ এবিএম ইউনূস ইয়ামিনের বাবা নূরুল আজিজকে বলেছেন, তাকে যতদ্রুত সম্ভব বোনমেরো ট্রান্সপ্লান্টই করাতে হবে। তবে বেঁচে যাবে সে। এতে খরচও পড়বে অনেক! ভারতেই এ চিকিৎসা করালে লাগবে ৫০ লাখ টাকা। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যায়ের ‘ডি’ ব্লকের ১৫তলার হেমাটোলজি বিভাগে আছে ইয়ামিন। সিদ্ধিরগঞ্জ, নয়াআটি এলাকার একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ত ইয়ামিন। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি স্কুল থেকে বাড়িতে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে নারায়ণগঞ্জ মেডিপ্লাস মেডিক্যালে পরীক্ষা করা পর ডাক্তার মাহাবুব তাকে রেফার করেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ এবিএম ইউনূসের কাছে। গ্রীন রোডের গ্রীন ভিউ ক্লিনিকে চিকিৎসারত অবস্থায় গত বছরের মার্চ মাসে ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার। এতদিন কেমোথেরাপি চলছিল। কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় তাকে নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। শিশুটির বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নূরুল আজিজ চৌধুরী এবং গৃহিণী মা সর্বস্ব দিয়ে চিকিৎসা খরচ চালিয়ে এখন নিঃস্ব। টাকার অভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিশুটির চিকিৎসা কার্যক্রম। ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় এবং দেশে পর্যাপ্ত উন্নত চিকিৎসার অভাবে অনেক ক্যান্সার রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ॥ বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ জাফর মোঃ মাসুদ জানান, হাসপাতালের খরচ ছাড়া ওষুধের দাম সবখানেই এক। তিনি মনে করেন এই বিশাল খরচ কমাতে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতা দরকার। হয় তো সরকারী হাসপাতালে, হাসপাতাল খরচটা ফ্রিতে পাওয়া যায়, কিন্তু ওষুধের দাম একই। এক্ষেত্রে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় বিশ্বের সব জায়গাই যাদের অর্থ আছে তারা সরকারকে সাহায্য করে। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোয়াররফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, দেশের জনসংখ্যা বাড়ার হারের সঙ্গে ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বাড়ছে, তা সামাল দেয়া অনেকটাই কঠিন। এক্ষেত্রে সবার আগে সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার, যাতে করে ক্যান্সারে আক্রান্ত না হতে হয়। এ জন্য তামাক সেবন থেকে শুরু করে যেসব কারণে ক্যান্সার হয় সেগুলো পরিহার করা জরুরী। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার গরিব মানুষের জন্য সারাদেশে বিনামূল্যে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা করা গেলে সারাদেশের চাপ কেবল ঢাকার একটি হাসপাতালে এসে পড়বে না। আর সিরিয়াল সঙ্কট কমে যাবে। এছাড়া ক্যান্সারের ওষুধও আগের চেয়ে অনেক সহজলভ্য এবং স্বল্প মূল্য হওয়ায় তা রোগীদের সাধ্যের মধ্যে চলে আসছে। রোগীদের বিদেশে পাড়ি ও চিকিৎসা খরচ ॥ দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা ও চিকিৎসকের ওপর আস্থাহীনতার কারণে প্রতিবছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রায় চার শতাধিক কোটি টাকা। এ ধারণা সংশ্লিষ্টদের। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার রোগী ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ ভারতসহ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন এমনকি জাপানেও যাচ্ছেন। দেশে চিকিৎসা সুবিধা ॥ দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অপ্রতুল। বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য প্রথম রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপিত হয় গাজীপুরে অবস্থিত কুমুুদিনী হাসপাতালে ১৯৫৩ সালে। দ্বিতীয় কোবাল্ট-৬০ মেশিন স্থাপিত হয় ঢাকা মেডিক্যালে ’৫৯ সালে। পরে ’৬৪ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে। দেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করে ’৮১ সালে। বর্তমানে ১৫০ শয্যাসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন তিনটি ডুয়েল এনার্জি লিনিয়ার এক্সিলেটর, দুটি কোবাল্ট-৬০ মেশিন, হাই ডোজরেট (এইচডিআর), ব্রাকিথেরাপি নিয়ে ক্যান্সার গবেষণা ও সেবা দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মেডিক্যাল অনকোলজি, সার্জিকাল অনকোলজি ও রেডিয়েশন অনকোলজিসহ বিভিন্ন বিভাগ এ নিয়েই মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেবা দিয়ে যাচ্ছে রোগীদের। আমাদের দেশের অধিকাংশ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞই ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট হিসেবে কাজ করেন যারা একই সঙ্গে রেডিয়েশন ও মেডিক্যাল অনকোলজি সেবা দিয়ে থাকেন। এছাড়া সার্জিক্যাল অনকোলজিতে ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
×