ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আইপিএল নিলামে বরুণ-চমক

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

আইপিএল নিলামে বরুণ-চমক

কিছুদিন আগেই সাবেক অসি তারকা মাইক হাসি বরুণকে চক্রবর্তী উপাধি দিয়েছেন ‘নতুন রহস্য স্পিনার’। মাদুরাই প্যান্থার্সকে তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জেতানো বরুণ প্রথমবারের মতো আইপিএলে এসেই ঝড় তুলেছেন। সেটি মাঠের বাইরে, নিলামে। আসন্ন ২০১৯ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল) ২৭ বছর বয়সী এই লেগ স্পিনারকে ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপীতে কিনেছে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব! বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা প্রায় ১০ কোটি (৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা)। তার ভিত্তি মূল্য ছিল মাত্র ২০ লাখ রুপী। তবে বরুণের ফেলে আসা জীবনের গল্প শুনলে রূপকথা বলেই মনে হবে। আর নিলামের অঙ্কটা হতে পারে সেই রূপকথায় নতুন ‘অধ্যায়’। ‘জানেন, নিলামে আমাকে নিয়ে চার ফ্র্যাঞ্চাইজির টানাটানি দেখে ভেতরে ভেতরে মারাত্মক উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। ঈশ্বরকে ডাকছিলাম মনে মনে। সত্যি, এখনও কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে।’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলছিলেন বরুণ। এবারের নিলামে পেসার জয়দেব উনাদকড়কেও সমান ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপীতে কিনে নিয়েছে রাজস্থান রয়্যালস। তামিলনাড়ুর স্পিনার বরুণের জীবনকাহিনী শুনলে বিস্ময়ে ঘোর লেগে যাবে। অন্য পেশা থেকে সরে এসে ক্রিকেটকে নেশা বানিয়ে ফেলা, উদাহরণ অপ্রতুল নয়। কিন্তু ক্রিকেট ছেড়ে প্রথমে অন্য পেশায় চলে যাওয়া। তার পর সেটা ছেড়ে ফের ক্রিকেটে ফিরে এসে আইপিএলে এই অবিশ্বাস্য মূল্য। এমন রূপকথার কাহিনী খুব কমই আছে। একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকা। সেখানে সুবিধা না করতে পেরে স্থাপত্যবিদ্যায় চলে যাওয়া। তার পর ভাল না লাগায় সেটা ছেড়ে ফের ক্রিকেটে ফিরে আসা। ‘পঁচিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছিল তখন আমার। গালভর্তি দাড়ি। কেউ চিনত না। আমিও কাউকে চিনতাম না। ক্রিকেটটা নতুন করতে শুরু করতে গিয়ে দেখলাম, বয়স এতই বেড়ে গেছে যে কেউ নিতেই চাইছে না ক্যাম্পে’ বলছিলেন বরুণ। তিনি আরও যোগ করেন, ‘কিন্তু তাই বলে লড়াই ছাড়িনি আমি। খেলা আবার শুরু করলাম। তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লীগ খেললাম। বিজয় হাজারে ট্রফি খেললাম। মাঝে কেকেআরে গেলাম নেট বোলার হিসেবে। সেখানে খুঁটিয়ে দেখলাম, সুনীল নারিন কীভাবে বল করে? প্রচুর টিপসও পেয়েছিলাম নারিনের থেকে।’ তার পরই কি বিস্ময়-স্পিনারে রূপান্তর? ‘আমি বিস্ময় স্পিনার কি না, জানি না। তবে হ্যাঁ, আমাকে খেলতে ব্যাটসম্যানের অসুবিধে হয়। আমি আসলে চেষ্টা করি, লাইন-লেন্থে রেখে বলটা করে যেতে। এমনিতে অনিল কুম্বলের ভক্ত আমি। ওঁর ধারাবাহিকতাটা নিতে চাই। প্রথমবারের মতো আইপিএল নিলামে এসেই সাড়ে ৯ কোটি! ‘জানি, অনেক টাকা। কিন্তু আমি সাড়ে ৯ কোটি টাকা কোন দিন পাব ভেবে খেলাটা আবার শুরু করিনি। টাকার অঙ্ক আমার দায়িত্বই শুধু বাড়াবে। আর কিছু নয়।’ পাঁচ বছরের পড়াশোনা শেষে স্থাপত্যবিদ হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করছিলেন বরুণ। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে বরুণ বুঝতে পেরেছিলেন, এই জায়গা আসলে তাঁর জন্য নয়। এই স্থাপত্যকলায় বন্দী থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। তাঁর ধ্যানজ্ঞান আসলে ক্রিকেট মাঠ। বরুণ বুঝে ফেলেছিলেন ২২ গজেই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটবে, স্থাপত্যকলায় নয়। তাই স্থাপত্যকলার কাজ পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন ক্রমবেস্ট ক্রিকেট ক্লাবে। তবে বরুণ এবার আর আগের পথে হাঁটেননি, উইকেটরক্ষক থেকে হয়ে যান সিমার অলরাউন্ডার। কিন্তু বরুণকে আবারও হতাশ হতে হয়। সিমার হিসেবে মাত্র দুই ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিল, আসলে তা এক ম্যাচ। দ্বিতীয় ম্যাচে খেলতে গিয়েই হাঁটুর চোটে ছিটকে পড়তে হয় মাঠের বাইরে, সেটি ছয় মাসের জন্য। বরুণের মনে তখনও একটা ভাবনা এসেছিল, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলো না তো? বরুণ ভাবনাটা নিজের মাঝেই ধরে রেখেছিলেন। এরপরই আসে পরিবর্তন। পেসার থেকে স্পিনার। চোট থেকে ফেরার পর তিনি নিজেকে পুরোপুরি পাল্টে ফেললেন। চেন্নাই লিগের চতুর্থ ডিভিশনে জুবিলি ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দিলেন স্পিনার হিসেবে। এবার সাফল্য ধরা দিল। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৮.২৬ গড়ে, ৩.০৬ রান রেটে তুলে নিলেন ৩১ উইকেট। রান পেলেন ব্যাটিংয়েও। সেই মৌসুমে জুবিলি ক্রিকেট ক্লাবের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও বরুণ! সেই মৌসুমেই সবার নজর কেড়ে নেন বরুণ। এতে ডাক পান আইপিএলের নেটে। চেন্নাই সুপার কিংসের নেটে ছিলেন চার দিন। তখন তাঁকে পছন্দ করে ফেলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ব্যাটসম্যান মাইক হাসি। বরুণের বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়ে কলকাতার অধিনায়কও তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের নেটে। এরপর শুরু হয় তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লীগ, মাদুরাই প্যান্থার্স বরুণকে দলে ভেড়ায়। সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে ৪ ওভারে ৯ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে মাদুরাইয়ের শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বরুণ। তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লীগের অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর বিজয় হাজারে ট্রফিতেও নিজের প্রতিভা দেখান তিনি। গ্রুপ পর্বে ২২ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। বরুণের ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছিল অবশ্য বল ধরতে ধরতে। শৈশবে বল করার চাইতে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে বল ধরাতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর। ১৩ বছর বয়স থেকে ক্রিকেট মাঠে আসা-যাওয়া। তখন উইকেটকিপারই হতে চাইতেন এবং ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত খেলেছেন কিপিং গ্লাভস হাতে। কিন্তু দলে খুব একটা সুযোগ পেতেন না। বয়সভিত্তিক দলগুলো থেকে বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বরুণ রাগে ক্রিকেটই ছেড়ে দিয়েছিলেন! মা-বাবার বাধ্য সন্তানের মতোই বরুণ ক্রিকেট ছেড়ে মনোযোগ দিয়েছিলেন পড়াশোনায়। লেখাপড়ায় তাঁর মাথাও ছিল খুব ভাল। চেন্নাইয়ে এসআরএম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যকলায় ডিগ্রীও নিয়েছেন। খেলাধুলার সঙ্গে তত দিনে সম্পর্ক শেষ বললেই চলে। কিন্তু মনে মনে ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা দাবিয়ে রাখতে পারেননি। অথচ দল পাননি মুশফিকুর রহিম। আর নিলামে নামই ওঠেনি চূড়ান্ত তালিকায় থাকা আরেক বাংলাদেশী তারকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের!
×