ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফা খন্দকার

নীলের কোলে শ্যামল সে দেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৮

নীলের কোলে শ্যামল সে দেশ

সৈয়দপুর থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইটের ছোট্ট প্লেনটা ধীরে ধীরে ডানা মেলেছিল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ পানে। অথচ আমি তখন বুকের ভেতর সজল কালো মেঘ নিয়ে জানালার কাঁচের এপার থেকে ব্যর্থ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম মাটিতে। যেখানে তৃণাবৃত মসৃণ জমি, ফসলের প্রান্তর আর বনভূমি হয়ে ওঠা বৃক্ষ- সব মিলিয়ে যেন সবুজাভ এক উপত্যকা। দেশে থাকতে আশির দশকে ছুটিতে বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে ঢাকা-সৈয়দপুর করা হতো, তখন প্রান্তরের এমন অজানা সবুজ আর সবুজ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। গতবারের আগের দফায় ১৫ সালে যখন দেশে এসেছিলাম তখনই হয়েছিল এই নতুন অভিজ্ঞতা। তার আগের বছর বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল কানাডার রাজধানী অটোয়াতে। সৈয়দপুরের আকাশে পৌঁছতেই আশ্চর্যের মতো বিস্ময় বিমুগ্ধ চোখে দেখা মিলল যেন সেই অটোয়ার প্রান্তর। রাজধানী অটোয়া যেতে যখন ফিলাডেলফিয়া হয়ে প্লেন বদলে যাতে আরোহণ করা হলো সেটা এতই খুদে, যার আসন সংখ্যা হবে সাকল্যে ১৫/১৬ জনের। তারপর ঘণ্টাখানেকের যাত্রাপথে উর্ধলোক থেকে চোখে পড়ল কেবলই সবুজের রকমারি পোট্রেট। কিন্তু অবাক হলাম যখন ইংরেজীতে ঘোষণা হলোÑ “আমাদের প্লেন এখন কানাডার ‘আঠওয়া’ এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছে।’ অবাক হওয়ার কারণ আমরা যাকে উচ্চারণ করি অটোয়া তার চারদিকে কোন উঁচু দালান-কোঠার দেখা নেই। চারদিকে কেবল সবুজ গাছপালা, জলাশয় নিয়ে এক উপত্যকা কি করে কানাডার মতো সুবিশাল এক দেশের রাজধানী হতে পারে! ইদানীং আমাদের পাশের নগর কানাডার টরেন্টো অবধি উঁচু উঁচু দালানকোঠা, রাস্তাঘাট নিয়ে জনবহুল হয়ে উঠেছে। নব্বইয়ের শুরুতে পরবাসী হয়ে দেশে ফিরে একবারই উড়তে উড়তে নব্বইয়ের মধ্যভাগে রংপুরে যেতে পেরেছিলাম বিমানের ঢাকা-সৈয়দপুর রুটটি ধরে। প্রকৃতি তখন সবুজ এমন পান্নার দ্যুতি ছড়ায়নি। দেশের সর্বত্র সে সময়টি পর্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে চলছে বন কেটে উজাড় করা আর পাখিদের তাড়ানোর সংস্কৃতি। এর পরের অনেক দেশ ভ্রমণেই বলাকার ছবি আঁকা সুপরিচিত খুদে বিমানটিও বিতাড়িত হয়েছিল আমাদের সেই রুটটি থেকে। দীর্ঘ কয়েক বছর ঢাকা থেকে রংপুরে যেতে হয়েছে বাসে করে। সে সময় তো শুধু প্লেন নয়, যুগ যুগ ধরে চলা দূরপাল্লার ট্রেনটি অবধি তাড়া খেয়ে পালিয়েছিল রংপুর থেকে। এ বিষয়ে দেশে প্রশ্ন করে যা জেনেছি তা হলো রংপুরের ভোটাররা বিজয়ী তৎকালীন শাসক দল বিএনপিকে ভোট না দেয়ার খেসারত। অবশেষে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবার পর হঠাৎ গায়ে পুলক লাগানোর অনুভবে একদিন শুনতে পাওয়া গেল বিমানের সৈয়দপুরগামী ফ্লাইট চলাচল নাকি আবার শুরু হয়েছে। আসলে হাজার হাজার মাইল যাত্রা করে ফের বাসযাত্রার ধকল অভিজ্ঞরাই জানে। ১৫ সালে দেশে যাওয়ার প্রাক্কালে আমার ভাগ্নে ময়নুলকে যখন তার খালু বলল ‘আমাদের দেশে যাওয়ার রিটার্ন টিকেট তো হয়ে গেল। এবার আগেভাগে ঢাকা-সৈয়দপুর টিকেট দুটোর বুকিং দিয়ে দাও।’ ভাগ্নে জবাব দিয়েছিল। ‘এখন তো মাসখানেক বাকি। বিএনপি জমানায় বন্ধ করে দেয়ার পূর্ববর্তী সময়ের অবস্থায় আজকাল আমরা নেই। তখন সপ্তাহে দুদিন দুটি ফ্লাইট চলত ঢাকা হয়ে রাজশাহী তারপর সৈয়দপুর। এখন সৈয়দপুরে প্রতিদিনই যাওয়া-আসা করে বিমান। একটি প্রাইভেট এয়ারলাইন্সও চলে। টিকেটের সংকট হবে না।’ মইনুলের খালু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- কিন্তু প্রতিদিন আসা-যাওয়া করার মতো বিমানের এত এয়ারক্র্যাফট আছে নাকি? গত বছর যাত্রার প্রাক্কালে একই প্রশ্নের উত্তরে মইনুল হাসতে হাসতে যে উত্তরটা দিয়েছিল সেটা সে মুহূর্তে যেন বিশ্বাস করার সাহস হলো না। আবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তাকে অবিশ্বাস করাও শক্ত। ও বলেছিল ‘আপনারা হয়ত এখনও জানেন না এই পথে প্রতিদিন বাংলাদেশ বিমান এবং প্রাইভেট মিলিয়ে ৬টি ডোমেস্টিক ফ্লাইট ওঠানামা করছে। তবে বিমানেরটা ভাড়া কম বলে কিছু চাপ অবশ্য থাকে।’ দেশ থেকে ওর সহাস্য কণ্ঠ শুনে মনটা কেমন টনটন করে উঠল বেদনায়-আনন্দে। এমনিতেই দেশের নানা সেক্টরে ফুলঝুরির মতো নতুন নতুন উন্নয়নের খবর শুনতে শুনতে বিস্মিত হতে বুঝি ভুলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু তাই বলে দেশের ডোমেস্টিক রুটে মির্জা ফখরুলের বিমান মন্ত্রিত্বের কালে যাত্রীর অভাবে নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সপ্তাহের দুদিন চলা এই রুট। পরিবর্তিত সময়ে একের পর এক দেশের আকাশযানগুলোর ১২ বার সৈয়দপুরের গগনপট মাতিয়ে তোলা কি দারুণ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা নয়? আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- এত যাত্রী পাওয়া যায়? ও বলেছিল- কি যে বলেন খালা, বাংলাদেশের মানুষ এখন কত যে বড়লোক এলে দেখতে পাবেন। আমার কর্তা মশাই দেশে থাকতে অনেকদিন বিমানে চাকরি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি এখনও তার ভালবাসা অবিচল বলে বলল- তুমি বিমানেরটা কেটে রেখ। কিন্তু বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া অধিকাংশ এসব কর্মকা- সম্পর্কে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। যা দেখি, শুনি সেটা সরকারী ভাষ্য। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় জানতে পারতাম এসব উন্নয়ন-ফুন্নয়ন সরকারের মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। তাদের কথায় জানতে পারতাম গণতন্ত্র ধ্বংসের কথা। নিউইয়র্কের পত্র-পত্রিকাগুলোতে মোটামুটি যা লেখা হয় দেখি তাতে মনে হওয়া বিচিত্র নয়, সেইসঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেছে দেশও। প্রবাসের প্রায় সব কটি বাংলা খবরের কাগজে দেশের অর্থনৈতিক চিত্র দেশ থেকে ফিরে এসেও চোখে পড়েছে। বহু দেশ ফেরতের কণ্ঠ অবশ্য এরই সঙ্গে গলা মিলিয়ে গায় না করা। আবার কেউ কেউ নীরব। আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে যেসব বুদ্ধিজীবী তাসরিফ রাখেন তাদের কথা বলবইবা কি? প-িতরা এসে বলেন গণতন্ত্র কায়েমের শতেক কথা। দেশ নাকি উচ্ছন্নেই চলে গেছে। সেখানে অন্ধদের হাতে নাকি দেয়া হয়েছে টর্চ আর চোখ ওয়ালাদের হাতে লাঠি। কিন্তু ফ্লাইটে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যে জুসের সঙ্গে অনেক চেনা দারুণ সেই প্যাটিসটি পরিবেশিত হলে বুঝলাম এটি শুধু চোখওয়ালা শেফের হাতে নয়, যারা বানিয়েছে তাদের রয়েছে গন্ধ ও স্বাদ সম্পর্কে সচেতন ইন্দ্রিয়। ঢাকার পূর্বাণীতেও এমন প্যাটিস মিলত এবং সেখানে থাকতে আমার কর্তা ভদ্রলোক যেটা প্রায়শই কিনে আনতেন। ক্ষুধার্থ ছিলাম, ভাললাগা ব্যাপারটাও কাজ করছিল। স্টুয়ার্ড ছেলেটিকে দ্বিধা নিয়ে বললাম ‘আর একটা প্যাটিস পাওয়া যাবে?’ সে হাস্যমুখে জিজ্ঞেস করল ‘দু’জনের জন্যই তো নাকি?’ খাবার বাসনপত্রগুলো ফিরিয়ে নিতে গিয়ে সে মৃদুহাস্যে জিজ্ঞেস করেছিল- আপনারা নিশ্চয়ই বিদেশে থাকেন! লজ্জাই পেলাম। কারণ সারা প্লানের কোন যাত্রী এমন হাভাতের মতো প্যাটিস চেয়ে নেননি নিশ্চয়ই। গত ১৭ সালে দেশ থেকে প্রবাসে ফেরার সময় এয়ারক্রাফটের ভেতরের বাতাস শুধু ভারি নয়, যেন টালমাটাল হয়ে পড়ল মার কোলে থাকা এক খুদে শিশুর কান্নায়। সেই তরুণী মাকে প্রায় সব শেষের যাত্রী হিসেবে প্লেনে উঠতে দেখেছিলাম। যে ছিল সাধারণ বাঙালী মেয়ের চাইতে দীর্ঘাঙ্গী, যার এক হাত কয়েকমাস বয়সের বাচ্চাকে কোলে নিয়েছিল, অন্য হাত বহন করছিল দুটি ভারি ঢাউস ব্যাগ। বাচ্চাটির সজোর কান্না কিছুতেই থামছে না। জননী তাকে দুলিয়ে ‘বাবা বাবা সোনামণি’ ইত্যাদি ডেকে, নানা আদরে থামাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়জুড়ে বৃথা যাচ্ছিল সব। সম্ভবত এয়ার প্রেসার ওকে কষ্ট দিচ্ছিল খুব। দেখলাম ১৫/২০ মিনিট চলে গেল, তবু কি আশ্চর্য এয়ার হোস্টেসটি এক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল গোমড়ামুখে আর যাত্রীরা রয়েছেন উচ্চ শ্রেণীসম নির্বিকার অভিব্যক্তি নিয়ে। কিন্তু আমরা দু’জন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। আমাদের বাল্য কৈশোরের পারিবারিক পরিবেশে পাশের বাড়ির শিশু সন্তান কাঁদলেও ছুটে আসত প্রতিবেশীরা। এই প্লেনে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দূরে থাক, কেউ কোন রাটিও কাড়ছে না। বুঝতে পারছি না আমাদের কি করণীয়। তবে প্লেন নিচে নেমে যাওয়ার আগে শিশুটি থেমে গেল। মা-ছেলে দু’জনই এক সময় হাসছে। আমরা যেন শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। তবে দু’জনেই একটু নিভৃতে কথা বলে নেই নিজেদের মধ্যে। যাত্রীরা সবাই নেমে যাচ্ছে, ওরা এবং আমরা সবশেষে। মা-ছেলের পাশে গিয়ে বললাম- যদি তোমার আঙ্কেল এয়ারপোর্টে নামবার সময় তোমার ব্যাগ দুটি ক্যারি করে তবে কি তুমি কিছু মনে করবে? মেয়েটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে লজ্জিত মুখে বলল- থ্যাংক ইউ আন্টি। আমরা পৌঁছানোর বেশ কিছুক্ষণ পর হাস্যমুখে ওরা দু’জন এলো। শুনলাম মেয়েটি গিয়েছিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টে মেজর হিসেবে কর্মরত তার সন্তানের বাবার কাছে ছুটি কাটাতে। শুনলাম মেয়েটি নিজেও আর্মিতে ছিল। কিন্তু এখন সেই চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ অক্সিডেন্টালে কাজ করছে। সামান্য কিছু পরে ও হঠাৎ জিজ্ঞেস করল- আপনারা কি বিদেশে থাকেন? -এ কথা তোমার কেন মনে হলো? -আপনারা যেভাবে এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করলেন? -বাহ্ এ কথা তোমার মনে হলো? এমন সাধারণ কাজ যে কেউ করত। -না আন্টি, এখন আমাদের দেশে এমনভাবে কেউ কাউকে হেল্প করে না। ওকে বললাম- দেখ আমি তো নিউইয়র্কে গাড়ি চালাই না। সাবওয়ে ধরে চলাচল করি। বাঙালী দোকানে হাট-বাজার করতে যাই কয়েক স্টেশন পেরিয়ে একা। কিন্তু ফেরবার পথে সাবওয়ের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা নামার মুহূর্তে কেউ না কেউ পাশে দাঁড়িয়ে বলে- ক্যান আই হেল্প ইউ! আর যার সঙ্গে বাচ্চার ভারি স্ট্রলার থাকে তাকে তো আমাদের শহরে ওঠানো-নামানোর লোকের অভাব হয় না। বিদায়ের আগে টেলিফোনে নম্বর বিনিময় করে শম্পা নামের মেয়েটি বলল- আঙ্কেল আন্টি পরেরবার দেশে এলে সিলেটে আমার বাড়িতে কিন্তু বেড়াতে যাবেন। আমরাও আগ্রহভরে বললাম- নিউইয়র্কে যদি যাও তবে এসো আমাদের বাড়িতে। কিন্তু ইচ্ছে হলেও একটা কথা ওকে বলা হলো না, সেটা হচ্ছে- এ কথা ঠিক আমার নিউইয়র্কে পথে-ঘাটে হেল্প করে মানুষজন। কিন্তু অচেনা-অজানা দু’জন মানুষকে বাড়িতে নেমনতন্ন করবে না কেউ। আসলেই এটাই আমার বাংলাদেশ। কিন্তু নবেম্বরে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় চলে আসার সেই সময়টিতে বাংলার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখে ভাসল শীতের সুতীব্র হিমেল স্পর্শে উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অপরূপ প্রকৃতির এক বিপরীত রূপ। শীতার্ত সবুজ পাতারা ডালপালা করেছে শূন্য, ভেসে গেছে দিক বালিকার ভেলায়। এমনকি ঘাস আর জলাশয়ের এখন বিবর্ণ করুণ রূপ। আসলে বাংলার মতো চিরহরিৎ ধনসম্পদ তো সে শীতের দেশে নেই। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×