ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাণিজ্য যুদ্ধ বিপর্যয় ডেকে আনবে

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৫ জুন ২০১৮

  বাণিজ্য যুদ্ধ বিপর্যয় ডেকে আনবে

এই তো সেদিন পর্যন্ত আমি সত্যিই ভাবিনি যে একটা বাণিজ্য যুদ্ধ ঘটতে যাচ্ছে। বরং আমি ভেবেছিলাম- যা হবে সেটা কতকটা বাবুকি অর্থাৎ জাপানের ঐতিহ্যবাহী নাটকের মতো। সেখানে আমেরিকার প্রধান বাণিজ্য অংশীদাররা বাহ্যিক কিছু ছাড় দেবে। সম্ভবত ট্রাম্পের দিকের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু আকর্ষণীয় সুবিধা দেয়া হবে যার ফলে ট্রাম্প ঘোষণা করতে পারবেন যে তিনি এই যুদ্ধে ‘জয়লাভ’ করেছেন এবং বাণিজ্যও অনেকটা আগের মতোই চলবে। আমি যে তুলনামূলকভাবে এই নির্দোষ ধরনের পরিণতি আশা করেছিলাম তার কারণ এই ছিল না যে ট্রাম্প সুপরামর্শ পাবেন বা গ্রহণ করবেন। বরং আশা করা গিয়েছিল যে, বৃহৎ পুঁজিই কথা কইবে। কর্পোরেশনগুলো এই ধারণার ভিত্তিতে ট্রিলিয়নকে ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে যে মুক্ত বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা পরিবেশের এক স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হতে চলেছে। বাণিজ্য যুদ্ধ হলে তাদের এসব বিনিয়োগ বানচাল হয়ে যাবে, বিপুল পরিমাণ পুঁজি আটকা পড়বে এবং আমি ভেবেছিলাম যে, বৃহৎ ব্যবসায়ীরা এই বার্তাটি হয় ট্রাম্পের কাছে নয়ত নিদেন পক্ষে কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেবেন। এই সদস্যরা তখন ট্রাম্পের কলাকৌশল খাটানোর সুযোগ সীতিম করার জন্য কাজ করবেন। কিন্তু এই রাজনৈতিক বিবেচনাগুলো কয়েক মাস আগেও যতটা যৌক্তিক বলে মনে হয়েছিল এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। গ্যারি কোহন চলে যাওয়ায় হোয়াইট হাউসে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের বাস্তব কোন রকম পাইপলাইন আছে কিনা তা পরিষ্কার নয়। স্কট প্রইট ও মিক মুলভ্যানির সঙ্গে কোন কোন গ্রুপের প্রকাশ্য যোগাযোগ থাকলেও এই গ্রুপগুলোর বাণিজ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা নয়। আর ট্রাম্পের ভিত্তি নিয়ে শঙ্কিত কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা কোন কিছুর ব্যাপারে ভূমিকা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি বৃহৎ পুঁজি বিপন্ন হলেও তারা কিছু করবে বলে মনে হয় না। এদিকে বাণিজ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো বাণিজ্য অর্থনীতি সম্পর্কে জানেন-বোঝেন এমন কারোর যোগানো তথ্য উপাত্ত ছাড়াই ট্রাম্পের খেয়াল খুশিমত নেয়া হয়। আর কূটনীতির ট্রাম্পীয় সংস্করণটাই এমন যে তার শুধু বাণিজ্যগত পদক্ষেপ গ্রহণের কারণেই নয় উপরন্তু পরিকল্পিতভাবে নিষ্ঠুর একনায়কদের প্রশংসা ও গণতান্ত্রিক নেতাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের কারণে তার বিরুদ্ধে এক অতি ক্রুব্ধ জগত তৈরি হয়ে গেছে। সেই জগতের কেউই ট্রাম্পের জয়লাভের ভাবটুকু পর্যন্ত প্রকাশ করতে দিতে রাজি নন। আর নির্বাচিত নেতারা সেটা করলে ভোটারদের হাতে তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। কাজেই গুরুতর ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধ এখন খুবই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে এবং সেই যুদ্ধের অর্থ কি হতে পারে তা নিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমার মতে এ ব্যাপারে প্রধান তিনটি প্রশ্ন আছেÑ ১. শুল্ক কতটা বেশি হতে পারে? ২. এর ফলে বিশ্ববাণিজ্য কতখানি কমে যাবে? ৩. বাণিজ্য যুদ্ধের মাশুল কতটা হবে? এ সবই খানিকটা জটিল প্রশ্ন। তবে এ কথা বলার যথেষ্ট সঙ্গত দৃষ্টান্ত আছে যে এক সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধে শুল্কের পরিমাণ ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পাল্লার মধ্যে হতে পারে। এতে করে বাণিজ্যের পরিমাণ বহুলাংশে কমে যাবে- হয়ত ৭০ শতাংশ হ্রাস পাবে। তবে বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক ক্ষতি অনেকে যতটা কল্পনা করেন বলে আমার ধারণা তার তুলনায় কমই হবে। হয়ত বৈশ্বিক জিডিপি ২ থেকে ৩ শতাংশ হ্রাস পাবে। এই শেষ হিসাবটায় অবশ্য অবিশ্বায়নের বিপর্যয়কর প্রভাব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কিছু লোক প্রকৃতই লাভবান হবে। তবে অনেক মানুষের যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় লোকগোষ্ঠী ও অনেক সম্প্রদায়সহ অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের বড় ধরনের ক্ষতি হবে- বিশেষ করে সেটা স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদে। . শুল্ক কতটা বাড়তে পারে? বাণিজ্য যুদ্ধ বলতে আমরা কি বুঝি? বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা বুঝি এমন এক পরিস্থিতি সেখানে বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সেই সব নিয়মকানুন ও চুক্তি বর্জন করতে পারে সেগুলো তাদের শুল্কের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের অনুমিত স্বার্থে একতরফাভাবে শুল্ক নির্ধারণ শুরু করতে পারে। এখানে অবশ্য সমস্যাযুক্ত শব্দটা হলো ‘অনুমিত’। অন্যান্য বিষয়ের মতো বাণিজ্যের ব্যাপারেও ট্রাম্পের ধারণাগুলো সাধারণভাবে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। আর সত্যি কথা বলতে কি, অন্যান্য প্রধান কুশীলব বিশেষ করে ইইউর অর্থনৈতিক নীতির কর্মক্ষমতা সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক চিন্তার জয়যুক্ত হওয়ার মতো উপযুক্ত নয়। কোন দেশ যদি আকারে এমন বড় হয় যেÑ তা নিজের রফতানি পণ্য, আমদানি করা পণ্য কিংবা উভয় পণ্যের বৈশ্বিক মূল্যকে প্রভাবিত করতে পারে তাহলে সে দেশের ‘অপটিমাল ট্যারিফ’ শূন্যের চেয়ে বড় হয়। এর কারণ নিজের বাণিজ্য সীমিত করে এমন দেশ বাণিজ্যের শর্তাবলী অর্থাৎ তার আমদানি পণ্যের মূল্যের তুলনায় রফতানি পণ্যের মূল্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে। এতে করে অন্য সবকিছু সমান থাকলেও প্রকৃত আয় বাড়ে। আর ‘অপটিমাল ট্যারিফ’ বাণিজ্যের উন্নত শর্তাবলীর অর্জিত সুফলের বিপরীতে বাণিজ্য হ্রাসজনিত ক্ষতি কমিয়ে দেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ যখন বিদেশ থেকে পণ্য অধিকতর সস্তায় কেনা যায় সেই পরিস্থিতিতে দেশে উৎপাদিত পণ্যের খরচ অপটিমাল ট্যারিফের বদৌলতে হ্রাস পায়। সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি দেশই যদি এ কাজ করে তাহলে বাণিজ্য হ্রাসজনিত ক্ষতি পোহাতে হয়। বাণিজ্যের উন্নত শর্তাবলীর সুফল এক্ষেত্রে জোটে না। কারণ একটি দেশ অন্যান্য দেশকে উদ্দেশ্য করে যা করার চেষ্টা করছে অন্য দেশগুলোও সেই দেশটিকে লক্ষ্য করে একই কাজ করছে। কাজেই শেষ অবধি ‘অপটিমাল ট্যারিফ যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে বাস্তব যুদ্ধের চেয়ে বরং অনেকটা অস্ত্র প্রতিযোগিতার মতো ব্যাপার। সেটা এই অর্থে যে এক্ষেত্রে সাধারণত কোন বিজয়ী থাকে না এবং নিষ্পত্তিও হয় না। স্রেফ বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয় হয় মাত্র। এখন এই অপটিমাল ট্র্যারিফ যুদ্ধের প্রভাব কিভাবে পরিমাপ করা যায়? এ জন্য দরকার বিশ্ব বাণিজ্যের একটি ‘গণনাযোগ্য সাধারণ সুস্থিতি’ মডেল উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রবাহ কিভাবে শুল্ক হারের ওপর নির্ভর করে এতে তা দেখানো হয়। এরপর বের করতে হবে একটা সুস্থিতি সেখানে অন্য আর সবাই যা করছে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি দেশ তার ‘অপটিমাল ট্যারিফ’ আদায় করে নিচ্ছে। এর মধ্যে অনেক রকমের ধারণা ও আরোপণ জড়িত। যার ফলাফল নির্ভর করছে এক দেশের পণ্যের বিকল্প হিসেবে অন্য দেশের পণ্য কত সহজে আনা যায় তার ওপর। এ এমন এক ধ্রুবক যার পরিমাণ করা কঠিন। তারপরও সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওসার অভিমত হলো বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে পণ্যের ওপর প্রায় ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হবে। অন্যদিকে নিসিটা এট আল কিছুটা ভিন্ন ধারণার ভিত্তিতে হিসাব করে দেখেছেন যে পণ্যের ওপর শুল্ক বর্তমান স্তর থেকে ৩২ শতাংশ বাড়বে। এসব হিসাবকে বড় বেশি বিমূর্ত মনে হলে আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য চুক্তির ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগে সর্বশেষ বড় ধরনের যে সংরক্ষণবাদী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেটিকে বলা হয় স্মুট-হাউলি ট্যারিফ। এতে শুল্কযোগ্য আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কের পরিমাণ প্রায় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। শুল্কের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, বেশিরভাগ আমদানির ক্ষেত্রে এমন সব পণ্য জড়িত ছিল যেগুলোর ওপর যে কোন কারণেই হোক মোটেই কোন শুল্ক বসানো হয়নি। আপনারা অবাক হয়ে ভাবতে পারেন আমি কেন ৫৯ শতাংশ বললাম না। কেননা ১৯৩২ সালে শুল্ক এমনই সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। কিন্তু ওটা ছিল এক ধরনের অঘটন- এমনকি সংরক্ষণবাদীরা যা চেয়েছিল তার চেয়েও বেশি। এ ছিল মুদ্রা সঙ্কোচনের ফল। মুদ্রা সঙ্কোচনের ফলে সেই সব পণ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণমূলক হার বেড়ে গিয়েছিল যেগুলোর শুল্ক ইউনিট প্রতি ডলারে সুনির্দিষ্টরূপে বর্ণিত ছিল- শতাংশ হিসাবে নয়। কাজেই ইতিহাস ও পরিমাণজ্ঞাপক মডেল থেকে বোঝা যায় যে বাণিজ্য যুদ্ধের পরিণতিতে শুল্কের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হবে। এই হার ৪০ শতাংশেরও বেশি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। . বিশ্ব বাণিজ্য কতখানি কমবে? যে কোন নির্দিষ্ট শুল্ক হারের ক্ষেত্রে বাণিজ্য হ্রাসের পরিমাণ আমদানি চাহিদার স্থিতিস্থাপকতার ওপর নির্ভর করে। পণ্যের দাম প্রতি এক শতাংশ বৃদ্ধি পেলে আমদানিও এক শতাংশ হ্রাস পায়। এই স্থিতিস্থাপকতাগুলোর হিসাব করাটাও বেশ কঠিন কাজ। মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ওঠানামা হলে আমদানি মূল্যেরও পরিবর্তন হয়। তবে এগুলো থেকে স্বল্পমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় মাত্র এবং প্রত্যেকেই মনে করে যে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিস্থাপকতার প্রভাব অনেক বেশি। ঐকমত্যের হিসেবে আমদানি চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা ৩ কিংবা ৪-এর মতো। তবে এখানে এ ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চয়তা নেই। আমরা সত্যিই যদি অপটিমাল ট্যারিফ যুদ্ধে বিশ্বাস করি তাহলে অবশ্য দেখা যাবে যে বাণিজ্যের পরিমাণের ওপর যুদ্ধের প্রভাব স্থিতিস্থাপকতার সুনির্দিষ্ট মূল্যের প্রতি বিস্ময়কর রকমের স্পর্শকাতরতামুক্ত। কারণ কি, কারণ অপটিকাল ট্যারিফ স্থিতিস্থাপকতার ওপরও নির্ভর করে। বিদেশীরা যদি আপনার উৎপাদিত পণ্য কেনা বাদ দিয়ে সহজেই বিকল্প পণ্য কিনতে পারে তাহলে অপটিমাল ট্যারিফ যথেষ্ট কম হবে। সেটা যদি তারা না করতে পারে তাহলে অপটিমাল ট্যারিফ বেশি হবে। কাজেই স্থিতিস্থাপকতা বেশি হওয়ার অর্থ শুল্ক কমে যাওয়া। আর স্থিতিস্থাপকতা কমে গেলে শুল্ক কমে যাবে এবং বাণিজ্যও একইভাবে হ্রাস পাবে। আমার সাদামাটা হিসেবে বলে যে, ব্যাপক ক্ষেত্রে বাণিজ্য প্রায় ৭০ শতাংশ হ্রাস পাবে। বাণিজ্যের মডেল যারা করে থাকেন তারা আমার এই হিসাবকে ভুলে প্রমাণিত করতে পারলে আমি খুশি হব। কিন্তু আমার হিসাবটা যদি ঠিক হয় তাহলে বলতে হবে যে বিশ্ব বাণিজ্য সত্যিই বড় আকারে হ্রাস পাবে। ৭০ শতাংশ হ্রাস পেলে আমরা মোটামুটি ১৯৫০-এর স্তরে ফিরে যাব। ট্রাম্প যদি সত্যিই আমাদের বাণিজ্য যুদ্ধে নিয়ে যান তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটাই তার বৈশ্বিক চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। . ক্ষতির পরিমাণ কত বড় হবে? ইতিহাসগতভাবে সংরক্ষণবাদী নীতির অশুভ ফল নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। বলা হয় যে স্মুট-হাউলি শুল্ক নীতির কারণেই মহামন্দা সৃষ্টি হয়েছিল ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমনটা ধরে নিতে প্রলুব্ধ হওয়ার কারণও আছে। কেননা বাণিজ্য যুদ্ধের পক্ষে ট্রাম্পপন্থীদের যুক্তি এতই নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ যে ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি একেবারেই বিপর্যয়কর না হয়েই যায় না। তবে সর্বদাই আমার শেষ কথাটি হলো আমি সত্যই দুঃখবোধ করি যখন আমার রাজনৈতিক অনুভূতি বা ধারণার কাছে আমার অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বাতিল হয়ে যেতে দেই এবং যখন দেখি যে সরল বাণিজ্য মডেলগুলোতে বাণিজ্য যুদ্ধকে মন্দ বলে উল্লেখ করা হলেও এ কথা বলা হয় না যে, এই যুদ্ধ সর্বনাশা বা বিপর্যয়কর। এই ভুলটি সংশোধন করার জন্য পূর্বে উল্লিখিত সেই সব গণনাযোগ্য সাধারণ সুস্থিতি মডেলগুলোর কোন একটিকে ব্যবহার করা উচিত যেখানে বলা আছে যে বাণিজ্য যুদ্ধে ক্ষতি হবে উল্লেখযোগ্য। তবে বিশাল আকারের নয়- জিডিপির ২ বা ৩ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। আমি যেটা করতে চাই তা হলো এই ক্ষতি কেন বিশাল আকারের হবে না সে সম্পর্কে আমার কিছু স্বতঃলব্ধ ধারণা তুলে ধরা এবং তারপর ব্যাখ্যা করা কেন এতকিছু সত্ত্বেও বাণিজ্য যুদ্ধ হবে অতিমাত্রায় ধ্বংসাত্মক। সেটা করার জন্য বাণিজ্য তত্ত্বের একটি ছোট্ট কদর্য গোপন সূত্রকে কাজে লাগাবে। বাণিজ্য বিষয়ক সব কাহিনী চূড়ান্তরূপে অবশ্যই হতে হবে সাধারণ ভারসাম্যমূলক। অর্থাৎ সেগুলোকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে সে একই সঙ্গে সব বাজারের হালচালের ওপর নজর রাখা হয়েছে। তথাপি বাণিজ্য নীতির যে বিশ্লেষণে আংশিক সুস্থিতি অর্থাৎ সাধারণ চাহিদা ও সরবরাহের সূত্রকে কাজে লাগানো হয় সেই বিশ্লেষণ থেকেই সাধারণত মোটামুটি সঠিক উত্তরটি পাওয়া যাবে। সেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী শুল্কের কারণে যখন আমদানি পণ্যের মূল্য ভোক্তাদের কাছে বেড়ে যায় এবং তারা কম পরিমাণে আমদানি পণ্য কেনে তখন কল্যাণমূলক খাতে লোকসানটা দাঁড়াবে মোটামুটিভাবে শুল্কহারের অর্ধেক। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে জিডিপির ১৫ শতাংশ আমদানি খাতে ব্যয় করে। ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করল এবং আমি যেমনটা বলেছিলাম বাণিজ্য ৭০ শতাংশ হ্রাস পেল। তাহলে ওয়েলফেয়ার খাতে লোকসান দাঁড়াবে ২০ শতাংশ বা জিডিপির ২.১ শতাংশ। এটা কোন ছোট সংখ্যা নয়, তবে তাই বলে বিশাল বড় সংখ্যাও নয়। মহামন্দার গোড়াতে থাকাকালে মার্কিন কংগ্রেসের বাজেট অফিস সিবিও হিসাব করে দেখেছিল যে আমেরিকা সম্ভাবনাময় জিডিপির ৬ শতাংশ নিচে পরিচালিত হচ্ছে। সেই ক্ষতিটা অবশ্য ছিল সাময়িক। অন্যদিকে বাণিজ্য যুদ্ধ চিরস্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। তবে ওয়েলফেয়ার খাতের এসব নিট লোকসান থেকে আসল বিষয়টিই হারিয়ে যেতে পারে। আর সেটা হলো সব কিছু তছনছ হয়ে যাওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে পণ্য রফতানির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ। এ সমস্ত পণ্যেই যে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজিত তা নয়। কারণ পণ্যের কিছু কিছু উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করা। কিন্তু তার পরও অর্থনীতির একটা বড় অংশ, হয়ত ৯ কি ১০ শতাংশ বৈদেশিক বাজারের জন্য উৎপাদনে নিয়োজিত। আর আমাদের যদি সেই ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় যেমনটি আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি তাহলে সেই অর্থনীতির সেই অংশের প্রায় ৭০ ভাগের মতো শ্রমিককে বলতে পারেন ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি শ্রমিককে অন্য কিছু করা শুরু করে দিতে হবে এবং রফতানি শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা অনেক সমাজের ওপর এর বহুগুণ প্রভাব এসে পড়বে। কারণ এরাও চাকরি হারাবে। এ হলো ‘চায়না শক্’ কাহিনীর উল্টো দিক মাত্র। আপনি যদি এ কথা বিশ্বাসও করেন যে চীনের রফতানির ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারায়নি তার পরও এর ফলে চাকরির গঠন বিন্যাস ও অবস্থান পাল্টেছে এবং এই পাল্টানোর পথে প্রচুর লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে যে ‘ট্রাম্প শক্’ সৃষ্টি হবে তার অভিঘাতের ব্যাপকতা হবে অনেক বিশাল আকারের। কি ঘটতে পারে তার আভাস আপনারা ইতোমধ্যেই যা ঘটছে তার মধ্যে পেতে পারেন। দিগন্তে যে বাণিজ্য যুদ্ধ উঁকি দিচ্ছে তাতে এ যাবত আমরা কেবল ছোটখাটো সংঘর্ষ ঘটতে দেখেছি। কিন্তু এর প্রভাব সয়াবিন চাষীদের এবং ইস্পাত ব্যবহারকারীদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, ইতোমধ্যে সয়াবিনের দাম দারুণ পড়ে গেছে এবং ইস্পাতের দাম যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধ হলে এ ধরনের আরও অনেক অনেক ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। আচ্ছা ঠিক আছে এমন ধরনের ঘটনা যে ঘটবেই তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বস্তুতপক্ষে এখনও আমার এ কথা বিশ্বাস করতে কঠিন বলে মনে হয় যে আমরা সত্যিই ওই পথে অগ্রসর হচ্ছি। তবে ট্রাম্পকে কিভাবে থামানো যাবে কিংবা তার দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে অন্যান্য বড় কুশীলবকে কিভাবে প্ররোচিত করা যাবে সেই সম্পর্কিত কোন সম্ভাবনীয় কাহিনীও আমার কাছে নেই। লেখক : মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও কলামিস্ট সূত্র : নিউইয়র্ক টাইম
×