ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গাজায় হামাসের নেতৃত্ব এখন কার হাতে

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৩ জুন ২০১৮

গাজায় হামাসের নেতৃত্ব এখন কার হাতে

গাজায় ২০১৪ পরবর্তী কয়েক দিনের ভয়াবহ ইসরাইলী নৃশংসতার পর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে অস্ত্র সম্বরণের ব্যাপক একটা সমঝোতা হয়েছে। গত ১৪ মে গাজার পূর্ব সীমান্তে বিক্ষোভ চলাকালে ইসরাইলী সৈন্যরা গুলি করে ৬০ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। এ নিয়ে ৩০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়ে যায়। গাজার এই বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতৃত্বে কিন্তু হামাস ছিল না। তবে হামাসের সমর্থন ছিল। বিক্ষোভ আন্দোলন ছিল প্যালেস্টাইনিয়ান সিভিল সোসাইটির পরিকল্পনার ফসল। এখন এর নেতৃত্ব দিচ্ছে একটি সমন্বয় কমিটি যার মধ্যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন আছে। শোনা যাচ্ছে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব হামাস হাইজ্যাক করে নিয়েছে। হামাসের নেতৃত্বে আছেন ৫৬ বছর বয়স্ক ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ফিলিস্তিনী ভূ-খ-ের তিনিই এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। একদিন তিনিই সম্ভবত সব ফিলিস্তিনীর প্রতিনিধিত্ব করবেন। ইসরাইলী সৈন্যদের গুলিতে ৬০ জন ফিলিস্তিনী নিহত হওয়ার দু’দিন পর গাজাবাসী যখন তাদের পরবর্তী করণীয় কি জানার জন্য যার কথা শুনতে টেলিভিশনের সামনে জড়ো হয়েছিল তিনি ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নন, গাজা শাসনকারী হামাসের আলঙ্কারিক নেতা ইসমাইল হাকিয়ে নন বরং এই ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইসরাইলী হত্যাযজ্ঞের বদলা নেয়ার জন্য তার ওপর জঙ্গীদের চাপ ছিল। কিন্তু আল জাজিরা টিভিতে তিনি ঘোষণা করেন যে হামাস শান্তিপূর্ণ গণপ্রতিরোধের নীতি অনুসরণ করবে। কতটা গোপনে এই গ্রুপটি লোকজনকে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় ঘিরে যেতে নিরুৎসাহিত করেছিল বলে শোনা যায়। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অনেকের কাছে বিবেচিত হামাসের এই ঘোষণাটি ছিল অপ্রত্যাশিত। আরও বেশি অপ্রত্যাশিত এই কারণে যে, ঘোষণাটি দিয়েছিলেন সিনওয়ার। ১৯৮০-এর দশকে গঠিত হওয়ার পর থেকে হামাস সর্বদাই উপদলে বিভক্ত ছিল। একদিকে ছিল অতি উগ্রপন্থী ব্যক্তিদের উপদল কাসাম ব্রিগেড এবং অন্যদিকে বাস্তববাদী পলিট ব্যুরো। ২০১৪ সালে ইসরাইলের সঙ্গে হামাসের তৃতীয় যুদ্ধের পর দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ গভীরতর হয়। ওই যুদ্ধে প্রায় ২৩০০ ফিলিস্তিনী ও ৭০ জন ইসরাইলী নিহত হয়। গত বছর হামাসের পলিট ব্যুরো গাজা পরিচালনার জন্য ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে বেছে নিলে ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনী উভয়েই বিস্মিত ও শঙ্কিত হয়েছিল এই ভেবে যে, ঠিক কোন্ ধরনের নেতা তিনি হতে যাচ্ছেন। ইসরাইলী সেনাপ্রধান বলে বসেন যে তাঁর নিযুক্তির মধ্য দিয়ে হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখার মধ্যে পার্থক্য মুছে গেল। গাজাবাসী শঙ্কিত বোধ করে এই ভেবে যে, যে মানুষটি এক সময় হামাসের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করেছিল এবং সেই বাহিনীকে দিয়ে ও নিজের হাতে ইসরাইলের দালাল হিসেবে চিহ্নিত বেশকিছু ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছিল। যার প্রায় দুই দশক কেটেছিল ইসরাইলের কারাগারে তার কাছে কারবারগুলো নিশ্চয়ই ত্রুটিপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। তাকে যারা সবচেয়ে ভালভাবে জানে তারা আরও জটিল একটি চিত্র তুলে ধরেছে। এক ইসরাইলী কর্মকর্তার ভাষায় তিনি অতিমাত্রায় উগ্রবাদী আবার একই সঙ্গে নির্মম বাস্তববাদী। হুবহু একই মূল্যায়ন করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী ফিলিস্তিনের সাবেক নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মদ দাহলান। দাহলান ও ইয়াহিয়া সিনওয়ার খান ইউনুসে একত্রে বড় হয়েছেন। ধূলিময় রাস্তায় ফুটবল খেলেছেন। এখন তাদের মধ্যে রয়েছে এক নীরব অংশীদারিত্ব। দাহলান হামাসের জাত শত্রু ফাতাহ থেকে আগত হলেও তিনি গাজায় আমিরাতি অর্থ পাঠিয়ে থাকেন এবং মিসরের সঙ্গে আলোচনায় হামাসকে সাহায্য করে থাকেন। হামাসকে একদা যারা বৈরুত, ইস্তানবুুল ও উপসাগরীয় দেশগুলোর আরামদায়ক বাসভবন থেকে পরিচালনা করত সেই সব নেতাকে সিনওয়ার কোণঠাসা করে ফেলেছেন। তিনি আপাতত গাজার অতি উগ্রবাদী কণ্ঠগুলোকেও স্তব্ধ করে রেখেছেন। সীমান্ত দিয়ে জঙ্গী চুকিয়ে ইসরাইলী শহরগুলোতে পাঠানোর জন্য হামাস কয়েক বছর ধরে মাটির নিচে সুরঙ্গের একটা নেটওয়ার্ক পড়ে তুলেছিল। কিন্তু ২০১৬ সালেই ইসরাইল নতুন ও গোপন প্রযুক্তির সাহায্যে সেগুলো চিহ্নিত করে ধ্বংস করে দেয়। কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহম্মদ দেইফ সুরঙ্গগুলো ধ্বংস হওয়ার আগে সেগুলো কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিনওয়ারই তাঁকে তা করতে দেননি। অবশ্য এগুলো থেকে হামাসের নীতির মৌলিক কোন পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যাবে না। হামাস যে এখন অধিকতর শান্তিপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছে সেটা নিতান্তই কৌশলগত। হামাস নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন। এমনকি গাজার অতি কট্টর জঙ্গীরাও স্বীকার করছে যেÑ তাদের হাতে সামান্য যে সব অস্ত্রশস্ত্র আনছে সেগুলো ইসরাইলের প্রতি গুরুতর কোন হুমকি নয়। তাছাড়া তাদের তো কোন সেনাবাহিনীও নেই। হামাসের বাস্তববাদী নেতারা মনে করেন যে ইসরাইলের সঙ্গে আরেক যুদ্ধ বেঁধে গেলে গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। এমনিতেই তো সেখানকার অবকাঠামো ও সেবা ব্যবস্থা অতি শোচনীয়। এ অবস্থায় ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে ঠিক করতে হবে গাজাবাসীর সার্বিক স্বার্থে তিনি কোন্ বাস্তবমুখী পথ বেছে নেবেন। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×