ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লতিফুল কবির

কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বিভ্রম

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

 কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বিভ্রম

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থাপনায় একটা মধ্যম আয়ের দেশে যা দেখা যায়- বাংলাদেশ কি সেদিকে হাঁটছে? প্রশ্নটা আসছে সাম্প্রতিক ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’-এর অন্তর্নিহিত আবেদনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। কী আছে এখানে? সমাজের অগ্রসর ছাত্র সমাজের এই আন্দোলনে সমাজ বাস্তবতা কি ফুটে উঠেছে, নাকি কোন বিভ্রম সৃষ্টি করছে অথবা এটা কি কেবল অক্ষমদের আর্তনাদ? আলোচ্য নিবন্ধে খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমে বাংলাদেশের বাস্তবতাটা বুঝতে চেষ্টা করি। বাস্তবতা, বিশেষ করে আর্থসামাজিক অর্থাৎ অর্থনীতির গতিপথ এবং সমাজে তার প্রভাবটা বুঝতে না পারলে এই আন্দোলনকে ঠিক বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি পঁচাত্তরের পরে কোন রাখঢাক ছাড়াই পুঁজিবাদের পথে হাঁটছে। মুক্তিযুদ্ধে সমাজতন্ত্র অথবা সামাজিক ন্যায় বিচারের যে অঙ্গীকারই থাকুক না কেন, পঁচাত্তরের পরের বাংলাদেশ সেই শর্ত থেকে সরে গেছে। এটাই বাস্তবতা। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রের সেই অঙ্গীকারে ফিরে যাবে, এটা আশা করা যায় না। দেশের অর্থনীতি সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদের পথ ধরলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার সুবিধার জায়গায় সমাজতন্ত্রের যে ধারণা তাকে ত্যাগ করেনি। কিন্তু রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দেয়ার বেলায় সে নির্মমভাবে কৃপণ, তখন সে সমাজতন্ত্র থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রায় বিনা খরচেই গণবিশ্ববিদ্যালয়সমূহে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছে। পুঁজিবাদী কোন রাষ্ট্র তার জনগণের জন্য এমন উদার হয় না। হওয়াটা বাঞ্ছনীয়ও নয়। যদিও সমাজতন্ত্রের মতো পুঁজিবাদেও সকল নাগরিককে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার পেছনে রাষ্ট্রের একটা দায় আছে; তবে, তার সীমা উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত। এর উপরে শিক্ষা অর্জন করতে হলে ব্যক্তির নিজস্ব বিনিয়োগ থেকেই করতে হয়। অনেক দেশে সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকে, তবে সেই অনুদান কোনভাবেই মোট খরচের এক তৃতীয়াংশের বেশি হয় না। অর্থাৎ কোন ছাত্রের চার বছরের গ্র্যাজুয়েশন করতে যদি তিন লাখ টাকা লাগে, তবে সরকারের অনুদান কোনভাবেই এক লাখের বেশি হবে না। বাকিটা ওই ছাত্রকে হয় নিজের আয় অথবা পিতা-মাতার আয় অথবা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মেটাতে হয়। অথচ, বাংলাদেশের মতো দেশে উচ্চ-মাধ্যমিকের পরে বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে এবং এটা দিতে গিয়ে তারচেয়েও বড় একটা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাবঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। এটা কার্যত অন্যায়। এরকম বহু বড় বড় অন্যায়ের উদাহরণ দেয়া যাবে যা অবলীলায় পার পেয়ে যাচ্ছে। কারণ আর কিছুই না, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সুবিধাবাদিতা। একে আর অন্য কোনভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। সমাজে উচ্চবিত্তদের মাঝে অনৈতিকতার একটা চর্চা সকল সময়ে দেখা গেছে এবং দেখা যায়। অনৈতিকতার চর্চা করতে গিয়ে তারা লৌকিক নিয়ম-কানুনকে অগ্রাহ্য তো করেই, মাঝে মাঝে তাকে জায়েজ করতে অলৌকিক নিয়ম হাজির করে অথবা অলৌকিক নিয়মের নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে। রোমান সাম্রাজ্য, মোগল সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে গত শতাব্দির শুরুতে ধসে পড়া অটোমান সাম্রাজ্যে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে অনৈতিকতা চর্চার ভয়াবহ রূপটি সম্পর্কে কমবেশি সকলে অবগত আছেন। এর বিপরীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সব সময় নৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরতে দেখা গেছে। ছোটখাটো স্খলন আছে, তবে তা বড় মাপে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বাধীনতার পরে এতটাই লাগামহীন হয়ে গেছে যেÑ তারা কেবল জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার হত্যার বিচার বন্ধে আইন করতেও দ্বিধা করেনি। নৈতিকভাবে এমন দেউলিয়া মধ্যবিত্ত বিশ্বে খুব কম দেশেই দেখা যাবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার এমন নজির বিশ্বের বহু দেশে বহু জাতির মধ্যেই আছে, কিন্তু এত দ্রুত ইতিহাসের সঙ্গে বেইমানি করার নজির বোধকরি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভোগবাদ। সরকারী সুবিধায় সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর প্লট নেয়া, সমিতির নামে সংরক্ষিত এলাকায় সামরিক কর্তাদের আবাসিক প্লট নেয়া, ব্যাংক ঋণের টাকা মেরে দেয়া, আয়কর না দেয়া, ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা, অবৈধ অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করা, এসব এতটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে এর মধ্যে অন্যায় খুঁজে পাওয়াটা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য এক প্রকার অসম্ভব হয়ে গেছে। সরকারী চাকরিতে কোটা-সংস্কার আন্দোলনটি বুঝতে হলে মধ্যবিত্তের এই বাস্তবতাটাকে হিসাবে রাখতে হবে। সরকারী চাকরিতে কোটা কেন? এর উত্তরে বলা হয় এটা আমাদের সংবিধানে আছে। কোন সন্দেহ নেই, সংবিধানে এমন বিধান রাখার পেছনের উদ্দেশ্য ছিল একটা ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু সংবিধানের বিধান তার উচ্চতম ধারণা থেকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আনতে গেলে দরকার হয় আইন। সরকার এবং জনগণের জন্য আইন। যা সংসদে অনুমোদিত হবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়িত হবে তার জন্য নির্দেশনা সেই আইনে থাকবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোটার বেলায় কোন আইন প্রণীত হয়নি। সরকারের একটা প্রজ্ঞাপন দিয়ে সংবিধানের এমন একটা বিধানকে বাস্তবায়ন করা সংগত নয়, সম্ভবও নয়। ফলে ন্যায়পাল নিয়োগের মতো সংবিধানে বর্ণিত কোটার বিধানটিও দিক-নির্দেশনাহীন এতিমের মতো অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। কোটা কেন শুধু সরকারী চাকরির বেলায় প্রযোজ্য হবে? বেসরকারী খাত কেন কোটার আওতায় আসবে না? বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে গণপরিবহন, ভৌত অবকাঠামো কি কোটার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে, না কি তেমন কিছু করার কোন আইন আছে? নেই। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। কোটার অন্যতম অংশ, বিশেষ করে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাংলাদেশের কর্মপরিবেশ তথা গণপরিবহন থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে স্যানিটেশন ব্যবস্থায় কোন ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি। ফলে একজন প্রতিবন্ধীর পক্ষে অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাচল করা একেবারেই অসম্ভব একটা ব্যাপার। এটা ঠিক যে, নারীদের জন্য পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত শিশু প্রতিপালনে ডে-কেয়ার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে সন্তানকে ঘরে রেখে একজন নারীর পক্ষে কাজ করাটা যে কতটা দুর্বিষহ তা কেবল ভুক্তভোগী নারীগণই ভাল বলতে পারবেন। কাজেই, ভৌত অবকাঠামোতে এসব দুর্বলতা দূর না করে কেবল কোটার মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগ দিলেই একজন প্রতিবন্ধী অথবা নারী স্বাচ্ছন্দ্যে তার কাজকর্ম করতে পারবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। প্রশ্ন হলো, কোটা-সংস্কারের আন্দোলন কি সেই প্রশ্নগুলোকে সামনে এনেছে। আনেনি। খুব গভীরে গেলে দেখা যাবে আন্দোলনকারীরা আসলে এসব বিষয় ভাবেইনি। ভাবার কথাও না। কারণ, কাজটা তাদের না। কাজটা আইন প্রণেতাদের। যারা সংসদে বসে বহু বিষয়ে অনির্ধারিত আলোচনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা খরচ করতে পারেন, কিন্তু যে আইন প্রণয়নের জন্য তাদের নির্বাচিত করা হয়েছে এবং যার জন্য তারা বেতনভাতাদি পাচ্ছেন, সেই কাজটাই তারা করেন না। সংবিধানে বর্ণিত অঙ্গীকারসমূহের মধ্যে কতগুলো অঙ্গীকার এখন পর্যন্ত আইনের মাধ্যমে বলবৎ করা হয়নি, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ তার হিসাব রাখেন বলে মনে হয় না। অর্থনীতি শাস্ত্রে ‘হ্যাংগিং ফ্রুট’ নামে একটা কথা আছে, যার অর্থ : চোখের সামনে যা ঝুলছে মানুষ তাতে আগ্রহী হয়। সেজন্য আমরা দেখব, ছাত্রদের আন্দোলনে ত্রিশ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। একটা সুস্থ সমাজে এ ধরনের আন্দোলন দানা বাঁধে না। বাঁধার সুযোগ পায় না, দরকারও হয় না। কারণ, আইন প্রণেতারা সময়মতো আইন করে, আইনকে সময়োপযোগী করে সংস্কার করে। আর আইন প্রণেতারা যেন সমাজের মধ্যে চলমান ক্ষোভ ও অন্যায়কে বুঝতে পারে, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ গবেষণাপত্র হাজির করে। বৃহত্তর অর্থে একেই সামাজিক চুক্তি বলা হয়ে থাকে। এগুলো অলিখিত চুক্তি, কিন্তু এগুলো আছে বলেই সেই সমাজকে সুস্থ সমাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেদিক দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সার্বিকভাবে ব্যর্থ এবং সামাজিক চুক্তি ভঙ্গকারী দ্বিতীয়পক্ষ। গণবিশ্ববিদ্যালয় কি ব্যক্তিমালিকানা বিশ্ববিদ্যালয়, তারা কেউই সামাজিক বাস্তবতাগুলোকে তাদের গবেষণার বিষয় করেনি। অথচ জনগণের করের টাকায় প্রতিপালিত হওয়ার কারণে গণবিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সামাজিক সমস্যা বিষয়ে আরও বেশি সংবেদনশীল হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা সেটা বলে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ টক-শোতে যতটা আগ্রহী ততটা কম আগ্রহী গবেষণায়। ধারণা করি, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে লাগামহীন অনৈতিকতা, তা থেকে আমাদের শিক্ষকগণও মুক্ত নন। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ‘শাহবাগ আন্দোলন’ আরেকটি উদাহরণ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় তার কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের আইনে যে ত্রুটি ছিল তা বিশ্ববিদ্যালয় আবিষ্কার করেনি। তেমনটি করে থাকলে আইন সংশোধনের জন্য অত বড় আন্দোলনের প্রয়োজন হতো না। একটা সুচিন্তিত এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কোটার মতো অতি প্রয়োজনীয় আইনটি না করার কারণে এবং বিশেষ করে সরকারী কোন আমলার মস্তিষ্কপ্রসূত হওয়ার কারণে সরকারী চাকরিতে কোটার প্রজ্ঞাপনটি প্রথম থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিবন্ধীরা অবহেলিত, নারীরা অবহেলিত, সেটা হয়তো সাদা চোখে দেখা যায়; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা অথবা উপজাতি? তারা কি অবহেলিত? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে গবেষণা দরকার। হয়তো অনেকে অবহেলিত, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা অথবা উপজাতিদের সকলেই কি অবহেলিত? হওয়ার কথা না। যদি হয়, তাহলে তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে এবং সেভাবেই প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করে কেবল কোটা দেখিয়ে তাদের অবহেলিত অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। বিগত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে অনুসৃত সরকারী প্রজ্ঞাপনের আওতায় কোন অবহেলিত জনগোষ্ঠী কিভাবে উপকৃত হয়েছে, তার খতিয়ান দরকার। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, চাকরির বিজ্ঞাপনে উদ্ধৃত শূন্য পদের সংখ্যাটি কেন কোটার আওতায় আসবে? পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান যখন পাঁচ হাজার পদের ব্যাখ্যা দেন, তখন তাতে বড় ধরনের ফাঁকিটা ধরা পড়ে যায়। কোটা যদি থাকে, তবে তাকে অবশ্যই মোট পদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারী চাকরিতে যদি মোট দশ লাখ পদ থাকে, আর তার দশ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়, তবে এক লাখ পদ নারীদের। এখানে কেউ আসতে পারবে না। যদি নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদের মধ্য থেকে একশত পদ শূন্য হয়, তবে সেই শূন্য পদ শতকরা এক শ’ ভাগ নারী দিয়ে পূরণ করতে হবে। এটাই কোটা। এভাবেই আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং আইনের উদ্দেশ্য অংশে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। যেমন: ‘১. বাংলাদেশে গণখাতের মোট পদের দশ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বর্তমানে বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতে সৃষ্ট সকল পদ এই হিসাবের আওতায় থাকবে। ২. বেসরকারী খাত বিশেষ করে ব্যাংক, বীমাসহ সেবাখাতের সকল পদে নারীদের জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে। ৩. (এভাবে সকল খাত উল্লেখ থাকতে হবে)’। তেমনটি করা হলে কোটার যে বিভ্রম সৃষ্টি হয়ে আছে, তা থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি দেয়া সম্ভব হবে। কোটা অবশ্যই সামাজিক ন্যায় বিচারের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। তাহলে আর প্রশ্ন উঠবে না। এবার অক্ষমতা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশির দশকের পর থেকে মুক্ত বাজারের হাত ধরে বিশ্বায়নের আওতায় চলে গেছে। এই যাত্রা একমুখী। যতদিন যাবে, বাংলাদেশ তত বেশি করে বিশ্বায়নের মহাসাগরে তরী ভাসাবে। এই যাত্রায় বাংলাদেশের পণ্য যেমন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে, তেমন করে বাংলাদেশীরা কর্মের খোঁজে দেশে দেশে দৌড়াবে। এর বিপরীতে বিশ্বের বহুদেশ থেকে বাংলাদেশে পণ্য ও সেবা আসার পাশাপাশি কর্মীও আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ও যোগ্যতা তৈরির অবকাঠামোটি সেই তুলনায় একেবারেই অপরিপক্ব। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ কী ধরনের পণ্য ও সেবা রফতানি করতে পারবে তা নির্ভর করছে শিক্ষা ও যোগ্যতা তৈরির অবকাঠামোটা কেমন তার ওপর। এগুলো আমলাদের কাজ না। প্রাথমিকভাবে এই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং দ্বিতীয়ত উদ্যোক্তাগোষ্ঠীর। গণখাতে শিক্ষার যে অবকাঠামো, তা কি বিশ্বায়নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? এই প্রশ্নের জবাব দিতে কেউ-ই আগ্রহী না। আমাদের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটগণ কি স্বাচ্ছন্দ্য সহকারে বৈদেশিক যোগাযোগের মতো খুব সাধারণ কাজটি করতে পারে, না পারছে? কোটা-সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃস্থানীয়কে টেলিভিশন সাক্ষাতকার দেখে হতাশই হতে হয়। প্রশ্নগুলো কঠিন ছিল না, কিন্তু তিন চারবার প্রশ্ন করেও সঞ্চালকের পক্ষে উত্তর বের করা সম্ভব হয়নি। এসব দেখে আমার মনে হয়েছে, বিশ্বায়নের কারণে যে সম্ভাবনার চাকরি বাজার বাংলাদেশীদের পায়ের কাছে এসে হামাগুঁড়ি দিচ্ছে, তার জন্য এরা প্রস্তুত না। অথবা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অবহেলায় নিজেদের অক্ষমতাকে তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে, ফলে বেসরকারী খাতে বড় বেতনের চাকরির পরিবর্তে গণখাতের কম বেতনের চাকরিটাই অনেকের আরাধ্য হয়ে গেছে। আর সেখানে কোটাকে একটা প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেছে তারা। প্রতিবন্ধকতা তো বটেই। কিন্তু আন্দোলনে বেগ পাওয়ার কারণটা কেবল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা না। কারণ, শুরু থেকেই কোটা কোন নায্যতা ও ন্যায়পরায়ণতার ধার ধারেনি। কোন এক আমলার খেয়ালের বসে তৈরি হিসাবকে রাজনৈতিক রং মাখিয়ে জায়েজ করা হয়েছে মাত্র। এর পেছনে কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া বিশ্বায়নের অনুপযুক্ত তরুণসমাজ। ফলে একঝাঁক অক্ষম কোটা নিয়ে উন্মাদনায় মেতেছে। কোটা বাতিলে তারা খুশি হতে পারে, কিন্তু তাদের আগামী দিনটি সুখের হওয়ার সম্ভাবনা কম। বহু আগে কোন এক আমলার মস্তিষ্ক থেকে আসা হিসাবের কারণে তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি এরা যখন আমলা হবে অথবা ইতোমধ্যেই যারা আমলা হয়ে আছেন, তাদের তৈরি কোন প্রজ্ঞাপন, বিদেশের সাথে সম্পাদিত কোন চুক্তির কারণে পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, আমাদের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বিনাবেতনে অথবা নামমাত্র বেতনে পড়ালেখার যে সংস্কৃতি সেটা থেকে বের হতে না পারলে, পুরো চাকরিখাততো বটেই সমাজে যে অরাজকতা তৈরি হয়ে আছে তা থেকে আশু মুক্তি মিলবে না। লেখক : ক্যালগারি, কানাডা
×