ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গভীর রাতে ভিসির বাসভবনে হামলা ॥ প্রাণনাশের চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১০ এপ্রিল ২০১৮

গভীর রাতে ভিসির বাসভবনে হামলা ॥ প্রাণনাশের চেষ্টা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে নজিরবিহীন জঘন্য হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। বাসভবনে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের এমন ঘটনা আর ঘটেনি। ভিসির বাংলোর কোন জিনিসপত্রই আর আস্ত নেই। বাঙালী সংস্কৃতির ঐহিত্য পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তৈরিকৃত নানা জিনিসপত্রও ভাংচুর ও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সোমবারও উত্তাল ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছিল বিক্ষোভকারীদের দখলে। সারাদিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। তবে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেনি। সংঘর্ষে শতাধিক আহত হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে ভিসি জানিয়েছেন, তাকে হত্যার জন্য হামলা চালানো হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি, হামলার সঙ্গে বহিরাগতরা জড়িত। তারা হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তদন্তকারীরা বলছেন, হামলাটি অত্যন্ত পরিকল্পিত। হামলাকারীরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ভিসির বাংলোতে থাকা সিসি ক্যামেরা ও ক্যামেরার ফুটেজ ধারণ করার মনিটরগুলোও ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। মূল হামলাকারীরা মুখে কাপড় বেঁধে রেখেছিল। এজন্য তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হামলাকারীরা ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশকারী এবং সরকার দলীয় স্লোগান দিয়ে তা-ব চালিয়েছে। হামলাকারীরা স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রবিবার রাতে কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ জলকামান থেকে গরম পানি, রাবার বুলেট, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে করে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। রাত দেড়টার দিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে শাহবাগে তুমুল সংঘর্ষ চলতে থাকে। ঠিক এই সময়েই ঘটে যায় নজিরবিহীন সেই ঘটনা। ভিসির বাসভবনে ইতিহাসের জঘন্যতম হামলার ঘটনাটি ঘটে। সরেজমিনে দেখতে গেলে ভিসির বাসভবনে কর্মরত কেয়ারটেকার হাসান আরিফ বলেন, আমি ১৯৭৮ সাল থেকে ভিসির বাংলোতে কর্মরত। জীবনে এমন হামলার ঘটনা দেখিনি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ স্যাররাও বলেছেন, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এমন হামলার ঘটনা ঘটেনি। রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রাত তখন দেড়টা বাজে। গেটে অনেক মানুষের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি এগিয়ে গিয়ে কি হয়েছে, দেখার চেষ্টা করি। গেটের ছিদ্র দিয়ে দেখি, শত শত বিক্ষোভকারী গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অনেকেরই মুখে কাপড় পেঁচানো। তারা গেট ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে পূর্ব দিকের দেয়াল টপকে ৫০/৬০ জন ভেতরে ঢুকে। এমন পরিস্থিতি দেখে আমি ভয়ে দৌড়ে ভিসির বাংলোর ভেতরে ঢুকি। সবাইকে দ্রুত বিষয়টি জানাই। স্যার দুশ্চিন্তা না করে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন। স্যার বা আমাদের ধারণাই ছিল না, তারা হামলা করতে পারে। সেই ভেবে আমরা ও স্যার এবং স্যারের ছেলে ও মেয়ে নিশ্চিতে ছিলেন। প্রায় দশ ফুট উঁচু দেয়ালের পূর্ব দিকের অন্তত ২০ ফুট জায়গার কাঁটাতার ছিঁড়ে ফেলে। প্রবেশকারীরা এরপর ভেতরের মূল গেটের তালা ভেঙ্গে ফেলে। অন্তত ৫শ’ লোক ভেতরে প্রবেশ করে। তারা লাঠিসোটা নিয়ে প্রবেশ করে। বাড়ির ঢুকার রাস্তার লাইট ভেঙ্গে ফেলে। ঢুকেই বাড়ির সামনে থাকা সব ফুলের টব ভেঙ্গে ফেলে। এরপর পুরো বাড়ি ঘেরাও করে নির্বিচারে হামলা চালাতে থাকে। তারা লাঠি দিয়ে বাড়ির সব কিছু ভেঙ্গে ফেলে। পুরো বাড়িতে রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। শুধু ভাংচুর করেই ক্ষান্ত হয়নি। হামলাকারীরা গেটের দারোয়ান আনোয়ারের পকেটে থাকা ১১ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে। আরেক দারোয়ান আনোয়ার উদ্দিন মোল্যার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনটিও নিয়ে গেছে। এরপর আমাকে ধরে। আমাকে মারধর করেনি। তবে আমি যাতে কোন কিছুতে বাধা না দেই, এজন্য হুমকি দেয়। আমার পকেটে থাকা ১৭শ’ টাকা ও মোবাইল ফোনটি নিয়ে গেছে। পুরো বাড়িতে দুই তলায় ১৪টি করে মোট ২৮টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে ভাংচুর করেছে। আমি ৪০ বছর ধরে ভিসির বাংলোতে চাকরি করছি। জীবনে এমন ঘটনা দেখিনি। তারা লাঠিসোটা ও রড দিয়ে পুরো বাড়ির প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে চালিয়ে ভাংচুর করে। এমনকি ভিসি স্যারের বেড রুমে পর্যন্ত হামলা করেছে। তখন স্যার ও ম্যাডাম, স্যারের একমাত্র মেয়ে এবং একমাত্র ছেলে বাংলোতেই ছিলেন। মেয়ের বেডরুমের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। দরজার একটি পার্ট ভেঙ্গে ফেলেছে। পুরো বাড়ির সবকিছু ভাংচুর করার পর বাড়ির পেছনে যায়। সেখানে থাকা ভিসি স্যারের দুটি প্রাইভেটকার ভাংচুর করে। আর বাড়ির গ্যারেজের বাইরে থাকা প্রক্টর ও একজন মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকের গাড়ি দুটি ভাংচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়িতে থাকা নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়েছে বলে ভিসি স্যার ও ম্যাডাম বলেছেন। বাড়িতে থাকা দুটি ফ্রিজের মাছ মাংসও লুট হয়ে গেছে। ছাত্ররা আন্দোলনের নামে এভাবে ভিসি স্যারের বাসায় হামলা, ভাংচুর, লুটপাট করতে পারে, এটি আমার বিশ্বাস হয় না। ফ্রিজে থাকা মাছ মাংস পর্যন্ত লুট হয়েছে। এর সঙ্গে ছাত্ররা জড়িত থাকতে পারে, তা আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ রাত দেড়টা থেকে দুটা পর্যন্ত বাসা বাড়ি থেকে এসে কোন ছাত্র আন্দোলন সংগ্রাম করেনি। আন্দোলন সংগ্রামে হলের ছাত্ররা জড়িত থাকতে পারে। আর মাছ মাংস লুট করে ছাত্রদের কোন লাভ নেই। কারণ যেসব ছাত্ররা হলে থাকে, তাদের রুমে ফ্রিজ নেই। তারা ডাইনিং বা ক্যান্টিনে খায়। তাদের মাছ মাংস লুট করে লাভ কি? এমনটাই দাবি করেছেন, সেখানকার মহিলা রাঁধুনীরা। তারাও বলেছেন, হামলা ও লুটপাটের সঙ্গে ছাত্রদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে। সোমবার দুপুরে সরেজমিনে ভিসির বাংলোতে গিয়ে দেখা গেছে, নিচ তলার ১৪টি কক্ষের কোন আসবাবপত্র আস্ত নেই। এমনকি বাড়ির একটি ফুলের টবও নয়। বাড়ির ভেতর থেকে জিনিসপত্র টেনে বের করা হয়েছে। সেসব জিনিসপত্র বাড়ির সামনে এনে ভাংচুরের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। নিচ তলায় ভিসির অফিস এবং দু’তলায় ভিসির থাকার কোন কক্ষ আস্ত নেই। বাড়ির একটি পানির কলও নেই। সবই ভেঙ্গে ফেলেছে। পুরো বাড়িতে শুধু কাঁচ আর কাঁচ। দরজা, জানালা, আসবাবপত্র, বিছানা, খাট, টেবিল চেয়ার, টেলিফোন, সিসি ক্যামেরা, ক্যামেরার ফুটেজ ধারণ করার মনিটর থেকে শুরু সব কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেখে মনে, বোলড্রোজার দিয়ে কোন বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙ্গা হয়েছে। শুধু দু’তলা বাংলোটির অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির প্রতিটি কক্ষের আসবাবপত্রের ভেতরে তল্লাশি চালানো হয়েছে। দেখে মনে হয়, সেটি কোন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়ি। এদিকে সোমবারও বিক্ষোভ হয়েছে। তবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতরে অবস্থান নেয়। আর পুলিশ শাহবাগ থানার সামনে, চাঁনখারপুল, বকশীবাজার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, পলাশী, নীলক্ষেত মোট, কাঁটাবন মোড়সহ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের রাস্তাগুলোতে অবস্থান নেয়। এ সময় এসব রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে একই দাবিতে সোমবার সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। দুপুর পর্যন্ত মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। আর ঢাকার আন্দোলনের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেটসহ সারাদেশে বিক্ষোভ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন পরিদর্শন শেষে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হামলাটি একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, হামলার পেছনে ইন্ধনদাতাদের খোঁজে বের করা হবে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। ভিসির সংবাদ সম্মেলন ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোঃ আক্তারুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আন্দোলনকারীরা ছাত্র ছিল না। তারা ছিল মুখোশধারী সন্ত্রাসী। তাকে হত্যার জন্য এ হামলা চালানো হয়।
×