ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মার্চের ঘটনাবহুল দিন

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৭ মার্চ ২০১৮

মার্চের ঘটনাবহুল দিন

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বা-চনে জনগণের রায়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় বাঙালীর স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই। একাত্তরের গোটা মার্চ মাসই ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে বাঙালী যে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল একাত্তর সালের মার্চ মাসে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ১ মার্চ ১৯৭১ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আকস্মিক এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। বঙ্গবন্ধু ওই সময় হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থান করছিলেন, সেখানেই তিনি ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। বেতারে ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালী জাতি অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের কী নির্দেশ দেন। ২ মার্চ ১৯৭১ ২ মার্চ ১৯৭১, এই দিনে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকায় শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকা এদিন ছিল হরতাল, মিছিল এবং কারফিউর নগরী। মিছিলে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে নিহত ও আহত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যায় তার প্রেস কনফারেন্সে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বার বার বাংলাদেশ উচ্চারণ করছিলেন। ৩ মার্চ ১৯৭১ পাঞ্জাব পাকিস্তান ফ্রন্ট (পিপিএফ) ভুট্টোর ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেন। তারা বাংলার জনগণের প্রতি অত্যাচার বন্ধের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে সারাদেশে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর এবং সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ১০ মার্চ ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সম্মেলন অনুষ্ঠান ও সম্মেলনের পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ৪ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক হরতালে প্রদেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে প্রচার শুরু করে। বেতার টেলিভিশন শিল্পীরা টেলিভিশন অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু বেতন প্রদানের জন্য অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। করাচী প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন ঢাকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিৃবতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণ-বিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ৫ মার্চ ১৯৭১ মার্শাল ল’ অথরিটি থেকে ঘোষণা করা হয়, ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশব্যাপী আন্দোলন আরও জোরদার হতে থাকে। ৫ম দিনের মতো হরতাল পালনকালে সশস্ত্রবাহিনীর গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় ৪ জন শ্রমিক শহীদ হন এবং ২৫ জন শ্রমিক আহত হন। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেডএ ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য বিকেলে করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহবানে সাড়া দিয়ে বিকেলে কবি সাহিত্যিক ও শিক্ষকবৃন্দ মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। এগার দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহবান জানান। রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, সারাদেশে নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। ৬ মার্চ ১৯৭১ সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। সংগ্রামী বাংলা সভা-সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল। সংগ্রামী জনগণকে সমর্থন জানাতে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে যোগ দেন। সকাল ১১টার দিকে সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাতকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ-শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তারের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর নিযুক্ত করেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সকল বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি জানান। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ
×