ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়েরা এখন আর বোঝা নয়

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১০ মার্চ ২০১৮

মেয়েরা এখন আর বোঝা নয়

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। জাতীয় কবির কবিতার মতো দেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের নারীরা যখন প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী, সচিব, ডিসি, এসপি, ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও, এসিল্যান্ড তখন গ্রামের সাধারণ নারীরা পিছিয়ে থাকবে কেন? তারাও স্বামীর সংসারে গিয়ে কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। গ্রামের এই সাধারণ নারীরা আজকাল হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে কাজ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মধুপুর উপজেলার দড়িহাতীল (তালুকপাড়া) গ্রামের পল্লী চিকিৎসক শফিকুল ইসলামের স্ত্রী সুমাইয়া ইসলাম সাথী একটি উদাহরণ। সাথী আজ ঘরে বসে না থেকে আধুনিক যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুতির ব্যাগ তৈরি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গ্রামের অন্য নারীকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য গড়ে তুলেছেন ‘সাথী পুতির ব্যাগ তৈরির স্কুল’। সাথী সন্তান পালনের পাশাপাশি একদিকে রং-বেরঙের পুতি দিয়ে মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ, পার্টস (হাত ব্যাগ) ও ফুলদানি তৈরি করে বিক্রি করছেন অপরদিকে আগ্রহী নারীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। পুতির ব্যাগ তৈরী ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাথী আজ অনেকটাই স্বাবলম্বী। তাকে আর স্বামীর কাছে হাত বাড়াতে হয় না। উল্টো তিনি স্বামীকেই অনেক সময় সহযোগিতা করতে পারেন। মধুপুর থানা মোড় থেকে চাপড়ি রোডের তালুকপাড়া নামক পাকা রাস্তার পশ্চিম পাশে গোয়ালা বাড়িতে ‘সাথীর পুতির ব্যাগ তৈরির স্কুল’ চোখে পড়বে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে পুতির ব্যাগের কাজ ও প্রশিক্ষণ। সুমাইয়া ইসলাম সাথীকে ঘিরে আঁখি খাতুন, আমিনা খাতুন, রাহিমা বেগম, নার্গিস আক্তার, হাজেরা বেগম, লিজা খাতুন, তানিয়া আক্তার, নুরজাহান বেগমসহ ১০-১৫ নারী কাজ করছেন। সাথী দেখিয়ে দিচ্ছে আর অন্য সে অনুযায়ী পুতি গাঁথছেন। তারা বেশিরভাগ ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্টস তৈরির কাজ শিখছেন। কেউ পুতি গাঁথছেন, কেউ পাতলা কাপড় লাগাচ্ছেন। আবার কেউ ব্যাগের মধ্যে জিপার লাগাচ্ছেন। ‘সাথীর পুতির ব্যাগ তৈরির স্কুলে’ গিয়ে কথা হয় উদ্যোক্তা সুমাইয়া ইসলাম সাথীর সঙ্গে। সাথী জানান, ৫-৬ বছর আগে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে পুতির ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেই ঘরে বসে কাজ শুরু করেন। এ কাজে আস্তে আস্তে সফলতাও আসতে থাকে। সাথীর এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেন তার স্বামী শফিকুল ইসলাম। সে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঘাটাইল ও মধুপুর থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্টস তৈরির সরঞ্জাম পুতি, প্লাস্টিকের সুতা, পাতলা কাপড় ও জিপার কিনে এনে দেন। তৈরিকৃত ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্টস আশপাশের গ্রামের মেয়েরা তা কিনে নেয়। অবশিষ্ট ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্টস মধুপুরের বিভিন্ন কসমেটিক্সের দোকানে পাইকারি বিক্রি করেন। প্রতিটি ভ্যানিটি ব্যাগ ৫শ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা এবং প্রতিটি পার্টস ২শ’ টাকা থেকে ৫শ’ টাকায় বিক্রি করা হয়। খরচ বাদে সাথীর প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। সুমাইয়া ইসলাম সাথী আরও জানান, পুতির ব্যাগের কাজ শিখলে নিজের সংসারও চলে অপরদিকে অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয় করাও সম্ভব। সাথীকে দেখে ঐ গ্রামের অনেক মেয়ে আজ পুতির ব্যাগের কাজ শেখার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা অবসর সময়টুটু অবহেলায় না কাটিয়ে পুতির ব্যাগ তৈরির কাজে লাগাচ্ছেন। প্রশিক্ষণার্থী আবিদা সুলতানা আঁখি জানান, পুতির ভ্যানিটি ব্যাগ ও পার্টস তৈরির কাজ শিখলে পরিবারের মেয়েদের ব্যাগের চাহিদা মিটবে। যা বাজার থেকে অধিকমূল্যে কিনতে হতো। তাছাড়া নিজে ব্যাগ তৈরি করতে পারি, এটা আতœীয়স্বজনরা জানলে তারাও ব্যাগ তৈরি করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করবেন। সাথীর স্বামী শফিকুল ইসলাম জানান, পর্দার মধ্যে থেকেও মেয়েরা অনেক কাজই করতে পারেন। কুটির শিল্পের কাজ কোন অংশেই অসম্মানের নয়। ধামাবাশুরী নুরানী তালিমুল কোরআন মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুল জলিল জানান, মেয়েদের অবহেলা না করে সাথী আক্তারের মতো কুটির শিল্পে কাজ করার সুযোগ দিলে অনেকেই সমাজে কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আমজাদ হোসেন সরকার জানান, ঘরে বসে না থেকে মেয়েদের সাথীর মতো ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে কাজ করা উচিত। এ বিষয়ে মধুপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আমিনা আক্তার জানান, আজকের মেয়েরা বাবা বা স্বামীর সংসারের বোঝা নয়। তারা অনেকেই আত্মকর্মস্থানে নিজেদের নিয়োজিত করছেন। সাথীর মতো আত্মনির্ভরশীল কাজ করলে সমাজ থেকে বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন অনেকটা কমে যাবে। -ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে
×