ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে ‘ঢাকা এ্যাটাক’ প্রশংসিত ‘হালদা’

ফিরে দেখা -২০১৭ ॥ চলচ্চিত্র মুক্তি কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

ফিরে দেখা -২০১৭ ॥ চলচ্চিত্র মুক্তি কমেছে

গৌতম পান্ডে ॥ সাফল্য-ব্যার্থতা মিলিয়েই আর একটি বছর পার করল দেশীয় চলচ্চিত্র। বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। এই অভিযোগ মূলত ব্যর্থতার আর ভেঙ্গে পড়ার। অনেকের মতে ফিরে দাঁড়াচ্ছে দেশীয় চলচ্চিত্র । প্রতি বছর নতুন প্রত্যাশা নিয়ে আরম্ভ হলেও ব্যর্থতার পাল্লা ভারি করেই বছর শেষ করতে হয়। এখন দেখার বিষয় ২০১৭ সালে দেশীয় চলচ্চিত্র কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে! একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। প্রযোজক এবং পরিবেশক সমিতির তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৭টির মতো। যার ভেতর একক নির্মাণের দেশি চলচ্চিত্র ছাড়াও ছিল যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র। তার আগের বছর ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল সর্বসাকুল্যে ৬৩টির মতো চলচ্চিত্র। এ বছর বিগত বছরগুলোর তুলনায় দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৫৩টির মতো চলচ্চিত্র। আরও একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৪টি। শুধু সংখ্যার দিক থেকে চলচ্চিত্র কমেনি, সেই সঙ্গে কমেছে মান এবং ব্যবসা। তবে আশার কথা ব্যবসায়িক ব্যর্থতার সমূহ সম্ভাবনা জেনেও প্রযোজকরা অর্থ লগ্নি করছেন। আবার একই সঙ্গে অতৃপ্তির বিষয় হলো প্রযোজকরা চলচ্চিত্রের পেছনে অর্থ লগ্নি করলেও দর্শকের রুচির দিকটি বিবেচনায় রাখেননি। অপাত্রে অর্থলগ্নি এবং মানহীন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে দুএকটি ছাড়া সারা বছর ঢালিউড তেমন কোন সম্ভাবনার চলচ্চিত্র উপহার দিতে পারেনি। তবে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মধ্যে কিছু চলচ্চিত্র ছিল ব্যতিক্রম, যা দর্শকরা বেশ ভালভাবে গ্রহণ করেছে। আবার কিছু চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে সফল না হলেও কোন কোন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। গত বছর চারটি আমদানি করলেও এবার তা বাড়িয়ে ভারত থেকে সাতটি চলচ্চিত্র আমদানি করা হয়। যৌথ প্রযোজনার ‘বস টু’ ও ‘নবাব’ চলচ্চিত্র দুটি মোটামুটি ব্যবসাসফল। ঢাকার বলাকা, পূর্ণিমা, আনন্দ প্রভৃতি সিনেমা হলগুলোর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে, কিছু তথ্য বেরিয়েছে চলচ্চিত্রবিষয়ক কিছু পত্রিকাতেও। যদিও উল্লিখিত চলচ্চিত্র নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক সমালোচনায় সরব ছিল। যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণার অভিযোগ তুলে ‘বস টু’ ও ‘নবাব’ যাতে ছাড়পত্র না পায় এ জন্য আন্দোলনে নেমেছিল চলচ্চিত্র ঐক্যজোট। অন্যদিকে জাজ মাল্টিমিডিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘নবাব’ ও ‘বস টু’র মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে চলচ্চিত্র মুক্তি প্রত্যাশীরা। চলচ্চিত্র দুটি মুক্তি না পেলে জাজের অধীনের হলগুলো বন্ধ করে দেয়ারও হুমকিও ছিল এবার। দীর্ঘদিন বাক্সবন্দী থাকার পর এ বছর মুক্তি পায় বুলবুল বিশ্বাসের ‘রাজনীতি’। এতে অভিনয় করেন শাকিব-অপু জুটি। বলা যায় বাস্তবতা যাই হোক বছরজুড়ে দর্শক প্রশংসার শীর্ষে ছিল দীপংকর দীপনের চলচ্চিত্র ‘ঢাকা এ্যাটাক’। এই চলচ্চিত্রটিকে ঘিরে ব্যবসায়িক সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একদিনে সারাদেশে চলচ্চিত্রটির চার কোটি টাকারও বেশি টিকেট বিক্রি হয়েছে বলে গুঞ্জন শোনা গেছে। চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন-আরেফিন শুভ ও মাহী। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকির নতুন চলচ্চিত্র ‘ডুব’ মুক্তি পায় এ বছরের ২৭ অক্টোবর। যার ইংরেজী টাইটেল ‘নো বেড অব রোজেস’। এ চলচ্চিত্রটি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছে বলেও গুঞ্জন রটে। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এর প্রতিবাদ জানান। কিছু দৃশ্য কর্তনের পর ভারত ও বাংলাদেশে একযোগে যৌথ প্রযোজনার এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। মুক্তির প্রথম দিন থেকেই দর্শক পায়নি চলচ্চিত্রটি। ১২ কোটি টাকার চলচ্চিত্রের এমন দৈন্যদশায় হতাশ চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও ব্যবসায়ীরা। অনেককে বলতে শোনা গেছে এতে ইরফান খান যেভাবে ভেঙে ভেঙে বাংলা বলে তাতে মনে হয়েছে আমরা ব্রিটিশ কোন কবি বা লেখকের বায়োপিক দেখছি। যাকে এই দেশে থাকার বদৌলতে জোর করে বাংলা শিখতে হয়েছে। বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও ভারতের এসকে মুভিজের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ‘ডুব’ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রোকেয়া প্রাচী, পার্ণো মিত্র প্রমুখ। নির্মাতা অনিমেষ আইচের সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ দেখতে অনেকেই হলে গিয়েছেন। চলচ্চিত্রে একটি পানি কোম্পানির লোগোর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্তই ঠেকেছে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। গল্প, প্লট, চরিত্র, রহস্যময়তাসহ বাণিজ্যিকভাবে সফল করতে যেসব আয়োজন প্রয়োজন ছিল, তার সবই ছিল ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ চলচ্চিত্রে। কিন্তু নির্মাতা সেগুলোকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শতভাগ সফল করে তুলতে এবং এসব কিছু নিয়ে একটা মালা গাঁথতে ব্যর্থ হয়েছেন। এতে মুকু চরিত্রে কলকাতার অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় তার নিজের মহিমা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তৌকির আহমেদ পরিচালিত ছবি ‘হালদা’ ছবি নির্মাণে মুন্সিয়ানার পরিচয় থাকলেও দর্শক টানতে পারেনি। চলতি বছর ‘তোমকে চাই’, ‘হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা’, ‘ওয়ান’, ‘পোস্ত’, ‘বলো দুগ্গামাই কি’, ‘ইয়েতি অভিযান’ ও ‘ককপিট’ নামে আমদানিকৃত চলচ্চিত্রগুলো দর্শকের মন কাড়তে পারেনি। এছাড়া এ বছর মুক্তি পাওয়া ব্যবসাসফল না হওয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে রকিবুল আলম রকিবের ‘মাস্তান পুলিশ’, ওয়াকিল আহমেদের ‘কত স্বপ্ন কত আশা’, মিজানুর রহমান লাবুর ‘তুখোড়’, রয়েল খানের ‘যে গল্পে ভালবাসা নেই’, তানিয়া আহমেদের ‘ভালবাসা এমনই হয়’, আকাশ আচার্যর ‘মায়াবীনি’, নাদের চৌধুরীর ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’, জাকির হোসেন রাজুর ‘প্রেমী ও প্রেমী’, ফখরুল আরেফিনের ‘ভুবন মাঝি’, মুনতাহিদুল লিটনের ‘শেষ চুম্বন’, বদরুল আমিনের ‘সত্যিকারের মানুষ’, সাফিউদ্দিন সাফির ‘মিসডকল’, মনির হোসেন মিঠুর ‘ভালোবাসা ষোলোআনা’, সায়মন তারিকের ‘ক্রাইম রোড’, বন্ধন বিশ্বাসের ‘শূন্য’, মিজানুর রহমান লাবুর ‘নুরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার’, হিমেল আশরাফের ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, রেশমি মিত্রর ‘হঠাৎ দেখা’, হাসিবুর রেজা কল্লোলের ‘সত্তা’, শামিম আহমেদ রনীর ‘ধেৎতেরিকি’, সজল আহমেদের ‘তুই আমার’, শাহ আলম ম-লের ‘আপন মানুষ’, স্বপন আহমেদের ‘পরবাসিনী’, মিজানুর রহমানের ‘মিলন সেতু’, মাহবুবা ইসলাম সুমীর ‘তুমি রবে নীরবে’, আবু সাইয়ীদের ‘ড্রেসিং টেবিল’, মারিয়া তুষারের ‘গ্রাস’, জসিম উদ্দিন জাকিরের ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’, মঈন বিশ্বাসের ‘মার ছক্কা’, মাশরুর পারভেজের ‘রাইয়ান’, এ আর রহমানের ‘এক পলকের দেখা’, আবদুল মান্নানের ‘রংবাজ’, শাহাদৎ হোসেন লিটনের ‘অহংকার’, জাহাঙ্গীর আলম সুমনের ‘সোনাবন্ধু’, আকরাম খানের ‘খাচা’, আলী আজাদের ‘ষোলোআনা প্রেম’, ইফতেখার আহমেদ ফাহমির ‘টু বি কন্টিনিউড’, মমতাজুর রহমান আকবরের ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’, জুয়েল ফারসির ‘কপালের লিখন’, রয়েল খানের ‘গেইম রিটানর্স, সরোয়ার হোসেনের ‘খাস জমিন’, সাজেদুল আওয়ালের ‘ছিটকিনি’, আবু সাঈদ খানের ‘আসবো না ফিরে’, দেবাশীষ বিশ্বাসের ‘চল পালাই’, মালেক আফসারীর ‘অন্তর জ্বালা’, সাইফুল ইসলাম মান্নুর ‘পুত্র’, অপূর্ব রানার ‘ইনোসেন্ট লাভ’, মোরশেদুল ইসলামের ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’ অন্যতম। আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছে বদরুল আনাম সৌদের ‘গহীন বালুচর’। সব মিলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সাল ঢাকাই চলচ্চিত্র রংহীনভাবে পার করেছে। হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র ব্যবসা করলেও সেগুলো আশাজাগানিয়া নয়। আসছে নতুন বছর দেশীয় চলচ্চিত্র নতুনভাবে জেগে উঠতে পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
×