ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফজলুল হক খান

মৃত্যুঞ্জয়ী জননেতা আবদুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭

মৃত্যুঞ্জয়ী জননেতা আবদুর রাজ্জাক

মৃত্যুকে কেউ রুখতে পারে না। জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তারই ফলশ্রুতিতে এক বিশাল শোক মিছিলের মতো আমরা ক্রমাগত এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই চলছে পৃথিবীর পদযাত্রা। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা হারিয়ে চলেছি আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত আপনজনকে। শোকের মিছিল হয়ে চলেছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। সন্দেহ নেই, মহাপ্রলয় পর্যন্ত প্রলম্বিত হতেই থাকবে আমাদের এই শোক মিছিল। শুরুতে আমাদের ছিল একটি জগত। তখন আমরা ছিলাম কেবল আত্মা। তারপর পেলাম আর একটি জগত, তখন আমরা হলাম পরস্পরে আত্মীয়। মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই যেন আত্মার আত্মীয়। মায়ার বাঁধনে বাঁধা সুতাহীন বন্ধন। কখন সে বন্ধন ছিন্ন করে বুক পেতে নিতে হবে নিয়তির তীর, শোকের শরাধার থেকে ছুটে আসা সেই অব্যর্থ শর কাকে কখন বিদ্ধ করবে আমরা কেউ তা জানি না। এমনই একটা অব্যর্থ শর গত ২৩ ডিসেম্বর, ২০১১ তারিখে বিদ্ধ করল পদ্মা বিধৌত পলল মৃত্তিকায় বেড়ে ওঠা একজন কোমল প্রাণের মানুষকে, যাকে বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করার প্রয়োজন নেই। যিনি স্বনামেই স্বনামধন্য, স্বগৌরবে গৌরবান্বিত, স্বমহিমায় মহিমান্বিত। তিনি আমাদের সকলেরই পরিচিত, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় রাজ্জাক ভাই। আজ তাঁর ষষ্ঠ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও বিন¤্র চিত্তে তাকে স্মরণ করছি। রাজ্জাক ভাইকে আমরা চিনি বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় নেতা, আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতিনির্ধারক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় বীর এবং একজন সৎ, নির্ভীক রাজনীতিবিদ ও সফল মন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু তার আর একটা পরিচয় আছে, সেটা হয়তবা আমরা অনেকেই জানি না। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াসের অন্যতম সংগঠক। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ গোপনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠন করেন। মূলত বিপ্লবী পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয় ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রকাশ্যে এ সংগঠনের কোন কর্মকা- ছিল না। কিন্তু শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে এ সংগঠন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এ সংগঠন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০টি গোপন শাখা কমিটি গঠন করতে সক্ষম হয়। প্রতিটি শাখা কমিটিতে ৫ থেকে ৭ জন সদস্য ছিল। সদস্যরা ছিলেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সৎ ও নির্ভীক কর্মী। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজার। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সিরাজুল আলম খান এবং আব্দুর রাজ্জাক স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের উদ্দেশ্য, গঠন, কর্মপদ্ধতি ও সাংগঠনিক বিস্তৃতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন এবং তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু এ সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে এ সংগঠনকে সহায়তা করেন তাঁরা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ, এম এ আজিজ, এম,এ হান্নান, সোহরাব হোসেন, ইউসুফ আলী, মোশারফ হোসেন প্রমুখ। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ, জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে সাধারণ নির্বাচন ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিলে পূর্ব বাংলার মানুষকে সংগঠিত করে ম্যান্ডেট আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলা ও মহাকুমায় বিপ্লবী ফোরাম গঠন করা হয়। ১৯৭০ সালের নবেম্বরে সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সাংগঠনিক বিস্তৃতি এবং কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের হাই কমান্ডে শেখ ফজলুল হক মণি এবং তোফায়েল আহমেদকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদকে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি হাই কমান্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সামরিক শাখা ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিল আপোসহীন। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সামরিক শাখা গঠনের উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড ডিফেন্স হিসাবে কাজ করা এবং কোন কারণে যদি মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় সেক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ করে শত্রুকে পরাস্ত করা। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স চারজন কমান্ডারের নেতৃত্বে চারটি সেক্টরে বিভক্ত ছিল। তাদেরকে সহায়তা করেন চারজন সহকারী কমান্ডার। রাজশাহী বিভাগের প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান এবং সহকারী প্রধান ছিলেন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) খুলনা বিভাগের প্রধান ছিলেন তোফায়েল আহমেদ এবং সহকারী প্রধান নূরে আলম জিকু। ঢাকা বিভাগের প্রধান ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং সহকারী প্রধান সৈয়দ আহমেদ। চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি এবং সহকারী প্রধান আ স ম আবদুর রব। আর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৬৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের মিলিট্যান্ট পাওয়ার বেইজ হিসেবে ‘আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ সৃষ্টি করেছিলেন। রাজ্জাক ভাই ছিলেন সেই বাহিনীরও প্রধান। এই বাহিনীর দায়িত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর সার্বিক নিরাপত্তা বিধান। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আনা নেয়ার কাজটি করতো এই বিশেষ বাহিনী। অগ্নিঝরা ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধুকে নিরাপদে মঞ্চে নিয়ে আসা এবং ঐতিহাসিক ভাষণ শেষে যথাস্থানে গোপনে পৌঁছে দেয়ার গুরুদায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন রাজ্জাক ভাই। জীবন-মরণের এই কঠিন দায়িত্ব পালনে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সব সময় ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহ-ভালবাসায়, অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি যেমন সর্বদা কাজ করে গেছেন তেমনি বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে গৌরবময় দায়িত্ব দিয়ে ধন্য করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, জিল্লুর রহমান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক আর আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। রাজ্জাক ভাইয়ের সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। তাঁর ¯স্নেহমাখা ব্যবহার নেতা-কর্মীদের আকৃষ্ট করত দারুণভাবে। তার সম্মোহনী শক্তি এবং বক্তৃতার মাধুর্য্য মানুষের মনকে সহজেই জয় করে নিতে পারত। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর নির্বাচনী এলাকা শরীয়তপুর। শরীয়তপুর ছিল মুসলিম লীগ অধ্যুষিত এলাকা। মুসলিম লীগের অনেক বড় বড় নেতা এই এলাকায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। জননেতা আবদুর রাজ্জাকের সাংগঠনিক দক্ষতায় মুসলিম লীগের ঘাঁটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। নতুন আঙ্গিকে, নতুন সাজে শরীয়তপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ফলে ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালে শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে রাজ্জাক ভাই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, সমাজতান্ত্রিক দর্শন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, মানবতাবাদী শক্তির পক্ষে অবিচল নেতৃত্ব দিতে তিনি বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে মানুষকে সংগঠিত করেছেন, দলকে সুসংগঠিত করেছেন। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে জাতীয় নেতৃত্বে স্থান করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার মাধ্যমে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য। রাজনীতি করে তিনি কি পেয়েছেন কি পাননি তা নিয়ে ভাবেননি কখনও। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ধারক ও বাহক আবদুর রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা কখনও মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার। তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে দেশব্যাপী যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিএনপি সরকার এ জন্য জাহানারা ইমাম, আবদুর রাজ্জাকসহ ২৪ জন নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও খুনীচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকে হত্যার জন্য খোঁজাখুঁজি করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে আবদুর রাজ্জাককে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৪ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জুলুম নির্যাতন সহ্য করে ১৯৭৯ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় পানিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম মূল সম্পদ পানি, এর প্রাপ্তি ও স্বার্থ সংরক্ষণে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ভারত-বাংলাদেশ পানি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পানি স্বার্থ দ্বি-পাক্ষিকভাবে সুনিশ্চিত করা হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষর তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অন্যতম মুখ্য অর্জন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি যেমন সফল ছিলেন, মন্ত্রী হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সফল ছিলেন। আজ তার ষষ্ঠতম শাহাদাত বার্ষিকীতে তাকে অবনত মস্তকে বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। লেখক : গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
×