ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

ঈদে মিলাদুন্নবীর মর্মকথা

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২ ডিসেম্বর ২০১৭

ঈদে মিলাদুন্নবীর মর্মকথা

আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর প্রথম সৃষ্টি নূরে মুহম্মদীর মানব সুরতে পৃথিবীতে তসরিফ আনয়নের দিনটি বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন। এই নূরে মুহম্মদীই হচ্ছেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নূর মুবারক। এই নূর মুবারক থেকেই বিশ্বজগতের সবকিছু বিকশিত হয়েছে। এই নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তাঁকে নবুয়ত ও রিসালতে অভিসিক্ত করে নবুয়ত এবং রিসালতের সূচনা করেন। প্রিয়নবী (সা) বলেছেন : আমি রসূলগণের ভূমিকা এবং নবীদের উপসংহার। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : স্মরণ কর, আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদের আমি যে কিতাব ও হিকমত দিয়েছি অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তাঁর সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবেন তখন নিশ্চয়ই তোমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ্) বলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এতদসংক্রান্ত অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম (সূরা আল ইমরান : আয়াত-৮১)। এই আয়াতে কারিমায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত আলী রাদিআল্লাহ তায়ালা আন্হু এবং হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আন্হু বলেছেন যে, আল্লাহ্ সব নবীর কাছ থেকে হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁরা যদি তাঁর আমল পান তাহলে তাঁর ওপর ইমান এনে তাঁকে সাহায্য করবেন আর যদি না পান তাহলে পরবর্তীদের কাছে এ খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুসারীদের বলে যাবেন। নানা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন ও ভাষান্তর হওয়া সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করি, ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদের ধর্মগ্রন্থে আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের এবং তাঁর পৃথিবীতে আগমনের আগাম খবর বিধৃত হয়েছে। তওরাতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নাম মুবারক ‘আহম্মদ’ দৃষ্ট হয় ‘হিমদা’ উচ্চারণে। জেরুজালেমে সোলায়মানের ইবাদত গাহে আগুন লেগে পুড়ে গেলে এবং ইয়াহুদীদের দীর্ঘকাল বন্দিত্বের যন্ত্রণার মধ্যে দিনগুজরানকালে তাদের একজন মহানবীর আগমনের আগাম খবর দেয়া হয় এভাবে- I will shake all nations, and the Himda of all nations will come and I will fill this house with Glory, says the Lord of hosts. -মহাপ্রভু বলেন : আমি প্রকম্পিত করে দেব সব জাতিকে অতঃপর সব জাতির হিম্দা আসবে এবং আমি পূর্ণ করব এই গৃহকে গৌরব দ্বারা (Haggai, 11,7-9)। উল্লেখ্য যে, হিব্রু হিম্দা ও আরবী আহম¥দ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ একই। অন্যত্র বলা হয়েছে যে, মহাপ্রভু বলেন : Behold, I will send my messenger, Suddenly he will come to this temple he is the adonai whom you desire and the messenger of the covenant with whom you are pleased, Lo, he is coming. দেখ, আমি আমার রসূল প্রেরণ করব, সহসা তিনি আসবেন এই ইবাদত গৃহে, তিনি সেই আদোনেই (প্রভু) যাঁকে তোমরা চাও এবং তিনিই সেই প্রতিশ্রুত নবী যিনি এলে তোমরা খুশি হবে। দেখ, দেখ, তিনি আসছেন (malakhi III, I)। এখানে লক্ষণীয় যে, প্রিয়নবী (সা)-এর নবুয়তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে আত্মার জগতে নবী-রসূলদের যে মীসাক Covenant গ্রহণ করা হয়েছিল তাঁর উল্লেখ রয়েছে এই উক্তিতে এবং তিনি যে জেরুজালেমে মসজিদুল আকসায় তসরিফ আনবেন তারও উল্লেখ রয়েছে। এটা সকলেরই জানা, মিরাজ গমনকালে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রথম মসজিদুল আকসায় তসরিফ এনেছিলেন এবং এখানে নবী-রসূলগণের জামাতে ইমামতি করেছিলেন। এটাও সকলের জানা যে, তিনি উর্ধগমনকালে যে পাথরখানির ওপর কদম মুবারক রেখেছিলেন সেই পাথরটি হযরত সুলায়মান (আ)-এর ইবাদতগাহের স্মৃতি বহন করে। জেরুজালেমে যে সোনালি গম্বুজবিশিষ্ট অষ্টকোণাকৃতির প্রাসাদ বা উড়সব ড়ভ ঃযব জড়পশ বিদ্যমান তা সেই পাথরটিকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অর্থাৎ নতুন নিয়মে সুসমাচারে দেখা যায়, প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আগমনের আগাম খবর বিধৃত আছে। যোহন বলেছেন : There is one that comes after me who is stronger than I, the Lace of whose shoes I am not worthy to untie, he will baptise you with the spirit and with fire. -আমার পরে এমন একজন আসছেন যিনি আমার চেয়ে অধিক বলবান, তাঁর জুতার ফিতা খুলে দেয়ার যোগ্যও আমি নই, তিনি তোমাদের বাপ্তাইজ করবেন মনন ও দ্যুতি দ্বারা। (ঔড়যহ, ও.২৬.২৭)। আমরা আরও দেখতে পাই বাইবেলে পেরিক্লাইটস, প্যারাক্লেট, প্যারাক্যালন, কস্ফোরটার ইত্যাদি নাম উচ্চারণ করে একজন শেষ নবীর আগমনের আগাম খবর বিধৃত হয়েছে। যিশু বলেন : I will pray the father he shall give you another comforter (periqlytos) that he may abide with you for ever. -আমি আমার স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করব এবং তিনি তোমাদের আরেকজন সান্ত¡নাদাতা দেবেন, যেন তিনি তোমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকেন (ঔড়যহ, ীরা, ১৬)। এখানে লক্ষণীয় যে, He may abide with you for ever দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত যে মহানবীর নবুয়ত অব্যাহত থাকবে সেই মহানবী হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কথাই বলা হয়েছে। তিনি খাতামুন্নাবীয়ীন, তিনি শেষ নবী। তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বাইবেলে যে প্যারাক্লেট, পেরিক্লাইটস প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর অর্থও যা আরবী আহম্মদ শব্দের অর্থও তাই-ই। আমরা দেখতে পাই, যিশু বলেন : Hwo beit, the spirit of truth is come, he will guide you in to all truth, for he shall not speak of himself, but whatsoever he shall hear, that shall he speak. -যা হোক, যখন সেই সত্য আত্মা আসবেন, তিনি তোমাদের তাবত সত্যের দিকে পরিচালিত করবেন। কেননা তিনি নিজের থেকে কিছু বলবেন না, তিনি যা শুনবেন কেবল সেটাই বলবেন (John, xvi, ১৩)। কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : তিনি নিজের থেকে কিছু বলেন না, এটা তো ওহী যা তাঁর কাছে প্রত্যাদেশ করা হয় (সূরা নজম : আয়াত ৩-৪)। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের আগাম খবর এবং তাঁর নবুয়তের যেসব তথ্য রয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করলে নবুয়তে মুহাম্মদীর সার্বজনীনতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। আমরা জানি পৃথিবীতে এক লাখ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল তসরিফ এনেছেন। তাঁরা কেউ এসেছেন একটি নির্দিষ্ট কওমকে হিদায়াত দান করার জন্য, কেউ এসেছেন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে সত্য পথে আহ্বান করার জন্য। কিন্তু একমাত্র প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে তসরিফ এনেছেন সমগ্র মানব জাতিকে হিদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেন : আপনি বলুন, হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহ্ রসূল। (সূরা আরাফ : আয়াত-১৮৫)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : হে রসূল আমি আপনার খ্যাতিকে বুলন্দ করেছি (সূরা ইন্শিরাহ্ : আয়াত ৪)। আমরা কুরআন মজীদে লক্ষ্য করি তাতে বহু নবী-রসূলের জন্মবৃত্তান্ত রয়েছে। এমনকি হযরত ইয়াহিয়া আলায়হিস্ সাল্লামের জন্মদিনে তাঁর প্রতি সালাম জানানো হয়েছে, সালামুন আলায়হি ইয়াওমা বুলিদা। (সূরা মরিয়াম : আয়াত-৫)। যাঁর নূর মুবারক সৃষ্টি করে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, যাঁকে তিনি সর্বপ্রথম নবুয়ত ও রিসালত দান করেছেন, পৃথিবীতে নবী-রসূল আগমনের ধারাবাহিকতায় যাঁর পৃথিবীতে সবার শেষে আগমন ঘটেছে এবং নবী-রসূল আগমনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, ইসলামের পূর্ণতা এসেছে সেই প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের সেই দিনটি সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন, সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ দিন। আল্লাহ্ আমাদের জন্য বহু আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার মধ্যে এমন একটি নির্দেশ দিয়েছেন যা তিনি নিজে করেন, তাঁর ফেরেশতারা করেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পেশ করেন, হে ইমানদারগণ তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পেশ কর এবং তাঁকে যথাযথ তাজিমের সঙ্গে সালাম জানাও (সূরা আহযাব : আয়াত-৫৬)। আল্লাহ্ নির্দেশের বাস্তবায়ন ঘটে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালনের মাধ্যমে, মিলাদ মহফিল ও মিলাদে কিয়াম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। হাদিস শরীফ থেকে জানা যায়, আল্লাহর নিকট দোয়া কবুলের প্রধান শর্তই হচ্ছে তাতে অবশ্যই দরুদ শরীফ থাকতে হবে। যে কারণে বছরব্যাপী মিলাদ ও কিয়ামের আয়োজন করে দোয়া করার ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর মিলাদ ও কিয়াম সাহিত্য গড়ে উঠেছে। বহু কাসিদা রচিত হয়েছে। ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর মর্মবাণী উপলব্ধি করা আমাদের সকলের কর্তব্য, কারণ নবীপ্রেম ছাড়া আল্লাহ্র ভালবাসা পাওয়া যাবে না। ইয়া নবী সালামু ‘আলায়কা/ইয়া রসুল সালামু ‘আলায়কা/ইয়া হাবীব সালাম ‘আলায়কা/সালাওয়া তুল্লাহ আলায়কা’। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট হযরত মুহম্মদ (সা)
×