ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল নেই মুক্তামণি, আবার ডান হাতে ব্যথা, চুলকানি

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৯ নভেম্বর ২০১৭

ভাল নেই মুক্তামণি, আবার ডান হাতে ব্যথা, চুলকানি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘আম্মু হাতটা একটু চুলকায়ে দাও। খুব চুলকাচ্ছে, ব্যথ্যাও করছে’ বিরক্তিকর ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলছিল শিশু মুক্তামণি। ‘হেমানজিওমা’ রোগে আক্রান্ত মুক্তামণির পুরো হাতে ‘স্কিন গ্রাফটিং’ করা হলেও হাতটি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। সব মিলিয়ে ভাল নেই মুক্তামণি। অস্ত্রোপচারের পর পুনরায় তার ডান হাতে ব্যথ্যা ও চুলকানি অনুভব করছে সে। এমনকি হাতটি ফুলে আবারও আগের মতোই হয়ে যাচ্ছে। ‘আমি কবে সুস্থ হব! আবারও আগের মতো আমার হাত চুলকায়, ব্যথ্যাও করে। এখন একেবারেই আমি উঠতে পারি না। সারাদিন শুয়েই থাকতে হয়।’ আশাহত মুক্তামণি এভাবে জনকণ্ঠকে কথাগুলো বলল। স্কিন গ্রাফটিংয়ের পর মুক্তামণির হাতটি সুস্থ হওয়ার পথে থাকলেও ক্রমাগত কেন বাড়ছে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন চিকিৎসকরাও। মঙ্গলবার ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ৬০৮ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, মুক্তামণি শুয়ে আছে। শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল সে। তার শরীর প্রায় কঙ্কালসার দেখাচ্ছে। পুরো হাতটিতে ‘স্কিন গ্রাফটিং’ করা হলেও তা এখনও পূর্বের ন্যায় রয়েছে। ফোলা কমেনি বরং চুলকানি ও ব্যথ্যা করছে। হাতটিতে এক সপ্তাহ পর পরই ড্রেসিং করা হচ্ছে। এছাড়া স্কিন গ্রাফটিংয়ের সময় তার পায়ের যেখান থেকে চামড়া নেয়া হয়েছিল সে জায়গায় ব্যান্ডেজ করা রয়েছে। তবে সেখানে কোন ব্যথ্যা নেই বলে জানায় মুক্তামণি। তবে হাতের চুলকানি মাঝে কমলেও তা পূর্বের ন্যায় বেড়ে যাওয়ায় ও হাত ফুলে ওঠায় দুশ্চিন্তায় আছে মুক্তাসহ তার পরিবার। তার মা আসমা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সব সময় শুয়ে থাকতে থাকতে মেয়েটি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শরীর এতটাই দুর্বল যে উঠে বসতে পারে না। ওর হাতটি নিয়ে আমরা সকলেই দুশ্চিন্তায় আছি। এত অপারেশনের পরও আমার মেয়েটির হাত ঠিক হচ্ছে না কেন? আগের মতোই ব্যথ্যা, চুলকানি ও ফোলা রয়েছে। এর থেকে যদি ডাক্তাররা মেয়েটার হাতটি কেটে ফেলত তাহলে হয়ত মেয়েটি সুস্থভাবে চলাফেরা করতে পারত। চোখের সামনে মেয়েকে শয্যাশায়ী অবস্থায় আর দেখতে পারছি না।’ কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের হাতটি আস্তে আস্তে ম্যাসেজ করতে লাগলেন তিনি। আরও বলেন, ‘একটু পর পরই বলে, আম্মু চুলকাচ্ছে, ব্যথ্যা করছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি হাত চুলকে, মালিশ করে দিই।’ তবে চিকিৎসক সামন্তলাল সেন মুক্তার শারীরিক অবস্থা ঠিক আছে বলে মন্তব্য করে জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘সে শারীরিকভাবে সুস্থ আছে। ঠিকমতো সব খাবারই খাচ্ছে। সর্বক্ষণিক অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। প্রথমে ৫০ শতাংশ এর পর হাতের বাকি অংশে চামড়া লাগানোর কাজ শেষ হয়। সুন্দরভাবে চামড়া জোড়া লাগছে। কোন সমস্যা আপাতত দেখছি না। এখনও ড্রেসিং করা হচ্ছে।’ আক্ষেপ করে মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম পুরো হাতে স্কিন গ্রাফটিংয়ের পর বোধ হয় হাতটি আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসবে। কিন্তু হাতটি আগের মতোই মোটা রয়েছে। সেই সঙ্গে আবারও চুলকানি হচ্ছে। মেয়েটি সব সময়ই মন খারাপ করে থাকে। দিন দিন সে সুস্থ হওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে! আমাকে বলে ‘আব্বু, আমার হাত ঠিক হবে না মনে হয়। অপারেশনের পরও আমি ভাল হব না!’ এসব কথা শুনে আমি আবার তাকে ভাল হওয়ার উৎসাহ দেই। আশায় আছি! মুক্তামণি তার হাতটি নাড়বে। ও সুস্থ হয়ে গেলে অপ্রাপ্তি বলে জীবনে কিছু থাকবে না। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইÑ সে যেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।’ মুক্তামণির সুস্থ হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্তলাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই বলেছি, মুক্তামণির বিষয়ে আমাদের কোন তাড়াহুড়ো নেই। ধীরে ধীরে আমরা ওর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সব দেখে-শুনে ওর শারীরিক অবস্থার কথা সব সময় বিবেচনা করেছি প্রতিটি অস্ত্রোপচারের আগে। আর ও তো এমনিতেই অপুষ্টিতে ছিল, নানা ধরনের জটিলতা ছিল। আর গত কয়েকটি অস্ত্রোপচারের এ্যানেসথেশিয়ার প্রভাবও রয়েছে তার শরীরে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাকে ভাল করার।’ হাতে রক্তনালির টিউমারে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থতার স্বপ্ন নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় আসে মুক্তামণি। স্বপ্ন পূরণের পথে কবে পৌঁছবে মুক্তামণি তা জানেন না চিকিৎসকরাও। কয়েক দফায় মুক্তামণির হাতে অস্ত্রোপচার শেষে গত ১০ অক্টোবর প্রথম চামড়া লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার অপারেশন শেষে ওইদিন মুক্তামণির পা থেকে চামড়া নিয়ে প্রতিস্থাপনের কাজ প্রাথমিকভাবে শেষ হয়। সেসময় ৫০ শতাংশ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। এরপর গত ৬ নবেম্বর সকালে মুক্তামণির পুরো হাতে চামড়া লাগানো সম্পন্ন হয়। সকাল নয়টার দিকে মুক্তামণিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। দেড় ঘণ্টার অপারেশনে পুরো হাতে চামড়া লাগানোর কাজ শেষ করেন চিকিৎসকরা। মুক্তামণির রোগটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারীভাবে বিনামূল্যে মুক্তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নেন। পরে ঢামেকে ভর্তি করা হয় মুক্তাকে। মুক্তার চিকিৎসার জন্য একটি বোর্ড গঠনসহ সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। গত ৫ আগস্ট মুক্তার ডান হাতের বায়োপসি সম্পন্ন হয়। ৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসকরা জানান, মুক্তার হাতের একাধিক অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে। এরপর ১২ আগস্ট প্রথম অপারেশন সম্পন্ন হয় মুক্তার। চিকিৎসকরা ওই অপারেশনকে ‘সফল’ বলে দাবি করেন। ৮ অক্টোবর ৪র্থ দফায় তার হাতে অস্ত্রোপচার হয়।
×