ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

’৯১ সালে বিদ্রোহের প্রথম বিচার ধামাচাপা দেয়ায় পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৮ নভেম্বর ২০১৭

’৯১ সালে বিদ্রোহের প্রথম বিচার ধামাচাপা দেয়ায় পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ তৎকালীন বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে বিডিআর বিদ্রোহের প্রথম বিচার ধামাচাপা দেয়ায় দ্বিতীয় দফায় পিলখানায় তথাকথিত দাবিদাওয়া আদায়ের নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটি ঘটে। প্রথম বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের বাঁচাতেই গোপনীয়তার অজুহাতে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। আজও প্রথম বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ‘বিশেষ সংক্ষিপ্ত আদালতে’ বিদ্রোহীদের প্রতীকী বিচার সম্পন্ন করা হয়েছিল। বিচারে ২০ বিদ্রোহীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। দুটো বিদ্রোহের আগে প্রায় একই ধরনের লেখা সংবলিত লিফলেট বিতরণ করা হয়েছিল। যা দুটো বিদ্রোহের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র থাকা স্পষ্ট করেছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিদ্রোহ মামলায় পিলখানা বিডিআর সদর দফতরের দরবার হলে স্থাপিত বিশেষ আদালতে সাক্ষী বিডিআরের হাবিলদার হাবিবের দেয়া জবানবন্দীতে এমন তথ্য ওঠে এসেছে। পুরনো নথি ঘেটে ওই সাক্ষীর দেয়া জবানবন্দীতে মিলেছে আরও অনেক অজানা তথ্য। আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে হাবিলদার হাবিব বলেন, ১৯৯১ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল’ এর ব্যানারে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সংবলিত ভুয়া ও উদ্দেশ্যমূলক তথ্য সংবলিত একটি লিফলেট পিলখানাসহ সারাদেশের বিভিন্ন বিডিআর স্থাপনায় বিতরণ করা হয়। পরিকল্পনা হয় বিদ্রোহের। তারই ধারাবাহিকতায় পিলখানায় অবস্থিত ৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ল্যান্স নায়েক মেডিক্যাল সহকারী মোঃ আব্দুল হামিদ পলিথিন ব্যাগে ভরে পুরনো কোয়ার্টার গার্ড এলাকা দিয়ে ৫টি শক্তিশালী হাতবোমা পিলখানায় নিয়ে রওনা হন। যাওয়ার সময় উর্ধতন কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ সময় সে পালিয়ে সৈনিক লাইনে আশ্রয় নেয়। পরে সৈনিক লাইন থেকে রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দী করে রাখা হয় কোয়ার্টার গার্ডে। ওই রাতেই পিলখানার ৩ নম্বর গেটের বাইরে ২ ও ৩ নম্বর গেটে মাঝামাঝি শিক্ষক কোয়ার্টারের পেছনে, ঢাকা সেক্টর ও রেকর্ড উইংয়ের সৈনিক লাইনের মাঝের পার্কে বিডিআরের কতিপয় বিদ্রোহী সৈনিক শক্তিশালী হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো পিলখানায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। পরবর্তীতে আতঙ্ক সৃষ্টির প্রকৃত কারণ বিডিআর বিদ্রোহ বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের খোঁজে বের করতে আব্দুল হামিদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যথাযথ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর ও কঠোর তদন্তের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বিষয়টির তদন্ত হয়নি। এমনকি আব্দুল হামিদকেও কোন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তদন্ত এবং অনুসন্ধান সেখানেই থেমে যায়। বিস্তারিত কোন তথ্য উদঘাটন না করেই আব্দুল হামিদের কাছ থেকে ‘কোন কিছুই পাওয়া যায়নি’ মর্মে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে দেয়া হয়। ওই সময় নওগাঁয় অবস্থানরত ১ রাইফেল ব্যাটালিয়ান থেকেও হাতে লেখা বিভিন্ন ধরনের সেøাগান সংবলিত লিফলেট উদ্ধার হয়। ঠিক একই সময়ে ১ নম্বর ব্যাটালিয়ানের ১৭ জওয়ানের একটি ড্রিল পার্টি পিলখানা বিডিআর সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ড্রিল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। পরে তারা আবার নিজ ব্যাটালিয়নে ফেরত যায়। উদ্ধারকৃত লিফলেটের লেখা ও বিতরণে ড্রিল পার্টির সব সদস্যের হাতের লেখা পরীক্ষা করে নায়েক আফজাল নামে এক জওয়ানকে চিহ্নিত করা হয়। বিষয়টির অধিকতর তদন্তের জন্য প্রত্যাগত জওয়ানদের কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাজশাহী সেক্টর সদর দফতরে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। এ সময় জওয়ানরা উত্তেজিত হয়ে লাঠিসোটা, বাঁশ, কাঠ নিয়ে ‘বিডিআর সৈনিক এক হও’ ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ ’সেনা অফিসার ফেরত যাও’ ‘গাড়ির চাকা ঘুরবে না’ ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই’ ‘বেতন ভাতা বৃদ্ধি চাই’ ইত্যাদি নানা ধরনের সেøাগান দিতে দিতে ব্যাটালিয়ানের প্রশিক্ষণ মাঠে উপস্থিত হতে থাকে। খবর পেয়ে উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। পরে বিদ্রোহীরা রেস্ট হাউজে হামলা, ভাংচুর, টেলিফোন লাইন ও ওয়্যারলেস যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ততক্ষণে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে বিডিআরের বিভিন্ন স্থানে। এ সময় পরিকল্পিতভাবে আক্রমণের জন্য বগুড়া সেনানিবাস থেকে সেনাদল এগিয়ে আসছে, এমন গুজব তুলে সেনা আক্রমণ মোকাবেলা করতে কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগার লুটের চেষ্টা চালায়। ওই সময় ডিএডি ওয়াহিদকে কাঁধে তুলে তাদের নতুন অধিনায়ক বলে উল্লাস করতে থাকে বিদ্রোহীরা। ওই সময় বিডিআর ট্রেনিং সেন্টার, বাইতুল ইজ্জত, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর ও খুলনাসহ বেশ কয়েকটি বিডিআর স্থাপনায় একই ধরনের বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। পরে তৎকালীন মহাপরিচালকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ‘বিশেষ সংক্ষিপ্ত আদালত’ বসিয়ে বিদ্রোহীদের বিচার করা হয়। বিচারে ২০ বিদ্রোহীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দেয়া হয়। কিন্তু আজও বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের আর খোঁজে বের করার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়নি। বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের আড়াল করতেই বিদ্রোহের বিষয়টি তৎকালীন সরকারের আমলেই ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। আজও প্রথম বিদ্রোহের নেপথ্য নায়কদের খোঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হয়নি। তৎকালীন সরকারের এ ধরনের অবহেলা, উদাসীনতা ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায়ই দ্বিতীয় দফায় গত ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় তথাকথিত দাবি দাওয়া-আদায়ের নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটি ঘটানো হয়। প্রথম বিদ্রোহের বিষয়টি ধামাচাপা না দিয়ে কঠোর বিচার করা হলে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটি নাও ঘটতে পারত। ২০১০ সালের ২৯ নবেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে পিলখানা বিডিআর সদর দফতরের দরবার হলে স্থাপিত পুনর্গঠিত বিশেষ আদালত-৭ এমন বক্তব্য দেন সাক্ষী হাবিলদার হাবিব। আদালতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের প্রতিনিধি ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মোঃ সোহরায়ার্দী, প্রসিকিউটর ২৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ সামছুর রহমান, স্পেশাল প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল, এ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ টিপু, এ্যাডভোকেট মোঃ মুনজুর আলম মুনজু, ফ্রেন্ড অব দ্য একিউজড হিসেবে বিডিআরে কর্মরত সেনা কর্মকর্তা মেজর মোবাশ্বের হোসেন চৌধুরী ও মেজর সৈয়দ সোহেল আহমেদসহ বেসরকারী আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
×