ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নৃত্যগুরুমাতা রাহিজা খানম ঝুনু আর নেই

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ২৭ নভেম্বর ২০১৭

নৃত্যগুরুমাতা রাহিজা খানম ঝুনু আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নৃত্যগুরুমাতা রাহিজা খানম ঝুনু আর নেই। রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার সকাল সাড়ে ৭টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন একুশেপদকপ্রাপ্ত এ নৃত্যশিল্পী (ইন্নালিলাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ বহু ভক্ত, শিষ্য ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সংস্কৃতি অঙ্গনে। রাহিজা খানম ঝুনুর বড় ছেলে আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস, কিডনি ও ফুসফুসজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ফুসফুসে পানি জমার পাশাপাশি তার কিডনি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। তবে দেশের কোন হাসপাতালে তার কিডনি ডায়ালাইসিস করা সম্ভব হয়নি। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সে সুযোগ আর আসেনি। রবিবার সকাল সাড়ে সাতটায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সর্বশেষ তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালের ডাঃ এ পি এম সোহরাবুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে রবিবার রাহিজা খানম ঝুনুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কায়েতটুলীর বাসভবনে। সেখান থেকে দুপুরে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সেখানে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার আয়োজনে শ্রদ্ধা জানায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চা ভীষণ কঠিন ছিল, নৃত্যচর্চা তো দুরূহ ব্যাপার ছিল। তারপর মেয়েদের সংস্কৃতি চর্চায় সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় হাজারো বাধা এসেছিল। রাহিজা খানম ঝুনু সেসব প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতা জয় করে নৃত্যচর্চা শুরু করেন। নৃত্যে একটি নতুন ধারা তৈরি করে সারাদেশে তার অসংখ্য শিক্ষার্থী তৈরি করে গেছেন। তার শিক্ষার্থীরাই তার ধারাকে অব্যাহত রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, আইয়ুব সরকারের শাসনামলে তিনি নৃত্যকলাকে প্রতিষ্ঠা করতে যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, তা সংস্কৃতি অঙ্গন আরও বহুদিন স্মরণ করবে। তিনি যখন ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ মঞ্চস্থ করলেন তখন তা আমাদের সংস্কৃতিতে হয়ে গেল এক বড় ইতিহাস। নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান বলেন, তার অনুপ্রেরণাতেই নৃত্যশিল্পের সঙ্গে বাংলার মেয়েরা যুক্ত হওয়া শুরু করেছিল। এভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সবার গুরুমাতা। সদালাপী এ মানুষটি সবাইকে ভীষণভাবে মাতিয়ে রাখতেন। তিনি চলে গেছেন, আমার মনে হচ্ছে, মাথার ওপর থেকে যেন ছাদ হারিয়ে ফেললাম আমরা। শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, আমি জানি, খুব কম নৃত্যশিল্পী আছেন যারা তার সান্নিধ্য পাননি। বিভিন্ন প্রজন্মের নৃত্যশিল্পীদের তিনি প্রভাবান্বিত করে গেছেন। নৃত্যশিল্পী সংস্থার পক্ষ থেকে সভাপতি মিনু হক বলেন, নাচটাকে অন্তর থেকে ভালবেসেছেন ঝুনু আপা। এত মোহনীয় ছিলেন তিনি, আমি এখনও তার পারফর্মেন্সের কথা ভাবলে শিহরিত হই। পরে মিনু হক জানান, তার খুব শীঘ্রই রাহিজা খানম ঝুনুর স্মৃতিতর্পণের উদ্দেশ্যে একটি স্মরণসভা করবেন। এরপর প্রয়াত নৃত্যশিল্পীর মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রয়াত বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, নৃত্যাঞ্চল, দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন, ঝংকার ললিতকলা একাডেমি, পল্লবী ড্যান্স সেন্টার, নৃত্যাক্ষ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সংঘ, স্পন্দন ও বাংলাদেশ থিয়েটার। শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে রাহিজা খানম ঝুনুর বড় ছেলে আহসান উল্লাহ তার মায়ের জন্য সকলের কাছে দোয়া চান। পরে প্রয়াত শিল্পীর মেয়ে ফারহানা চৌধুরী বেবী জানান, মরদেহের কথা বিবেচনা করে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নাগরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানটি করছেন না। জানা গেছে, ময়মনসিংহের ভালুকায় তার স্বামী সাবেক সাংসদ আমান উল্লাহ চৌধুরীর কবরের পাশে শেষ নিদ্রায় শায়িত হবেন নৃত্যগুরুমাতা রাহিজা খানম ঝুনু। রাহিজা খানম ঝুনু ১৯৪৩ সালের ২১ জুন মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবু মোহাম্মদ আবদুল্লাহ খান ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার এবং তার মাতার নাম সফরুন নেছা। ১৯৫৬ সালে ঝুনু নৃত্যে তালিম নিতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাফার প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৬০ সালে বাফা থেকে পাস করে তিনি বাফার নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৮ সালে অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রাহিজা খানম ঝুনু তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি পান একুশে পদক। তার পাওয়া উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি সংবর্ধনা, বেনুকা ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা কর্তৃক শ্রদ্ধাঞ্জলি, বুলবুল চৌধুরী স্মৃতি পদক।
×