ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আমেরিকার ক্যাম্পাসগুলোতে এসব কি হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

আমেরিকার ক্যাম্পাসগুলোতে এসব কি হচ্ছে

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ধ্যান-ধারণা আদান-প্রদানের সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্থান। তারপরও হালে এমন অভিযোগ উঠছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে স্বাধীনভাবে কথা বলতে বা মত প্রকাশ করতে দেয়া হয় না। কণ্ঠরোধ করা হয়। এমন অভিযোগ যারা করছেন তারা বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংস বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করেন, যার জন্য সাংবাদিক মিলো ইয়ানোপৌলাস বক্তৃতা দিতে পারেননি। কিংবা উল্লেখ করেন সেই বিক্ষোভের হুমকির কথা, যার জন্য আন কোল্টারের স্কুলে আসা বাতিল করতে হয়েছিল। সভয়ে তারা স্মরণ করেন মিডলবারী কলেজে চার্লস মারের বেলায় যা ঘটেছিল। স্মরণ করেন এমনি আরও দৃষ্টান্ত, যেখানে জট বেঁধে ছাত্ররা কনডোলিৎসা রাইসের মতো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, তার মানে কি আমেরিকার ক্যাম্পাসগুলোতে এমন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে যার লক্ষ্য বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব থেকে ছাত্রদের মুক্ত রাখা এবং এজন্য নানা ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দেয়া? এটা সত্য, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অনেক অধ্যাপক আছেন যারা তাদের কোন বক্তব্য বা লেখার জন্য হত্যার হুমকি পেয়েছেন। মেডিসনের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রক্ষণশীল আইন পরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং গবর্নর স্কট ওয়াকারের ভারে ভারাক্রান্ত। আইন পরিষদ সদস্যরা রক্ষণশীলদের রক্ষা করার নামে বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্ব করার জন্য ‘বক্তৃতা মুক্ত ক্যাম্পাস’ নামে অনেকটা ভ-ামিপূর্ণ আইন পাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত মার্কিন সাংবিধানের প্রথম সংশোধনী আবর্জনার বাক্সে ছুড়ে ফেলে দিতে চান। আদর্শগত নানা বিষয়ে হাজার হাজার বক্তৃতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দেয়া হয়। ছাত্ররা ক্লাসে যায়। বিভিন্ন সংগঠনে অংশ নেয় এবং বক্তৃতা শুনতে যায়। কোন ঘটনা ঘটে না। এই মারে কিংবা রাইস অথবা বেন শাপিরোই তো অসংখ্যবার ক্যাম্পাসগুলোতে বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে দৃষ্টি কাড়ার মতো কোন ঘটনা তো ঘটেনি। ইদানীং যেসব বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে তা প্রচলিত ধারা নয়। অথচ রক্ষণশীলরা তেমনই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তারা বলতে চাইছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো অসহিষ্ণু উদারপন্থীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যা মোটেই ঠিক নয়। নানা দিক দিয়েই ক্যাম্পাস ধ্যান-ধারণা আদান-প্রদানের সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্থান। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো রাজনৈতিক বিতর্কের আবেগ ও উষ্ণতা থেকে মুক্ত। এই আবেগ যেমন জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে পক্ষাবলম্বনে ইন্ধন যোগায় তেমনি তা ক্যাম্পাসেও বিশেষ করে তরুণদের হৃদয় ও মনে এসে উপস্থিত হয়। তারা এর বিরুদ্ধে লড়ে, কখনও কখনও তা বর্জন করে। আশা করা যায় যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা সেই জিনিসটি শেখে যা প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফার আইসগ্রুবার সম্প্রতি ছাত্রদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন: ‘মতানৈক্যের আর্টটা শুধুমাত্র সংঘাত বা মোকাবেলার ব্যাপার নয়, শিক্ষার ব্যাপারও বটে। এর জন্য আমাদের নিজেদের বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে দাঁড়াতে হয় এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল বোঝা হতে পারে কিনা। কিন্তু কিছু কিছু বক্তা এই শেখার কাজটাকে সম্ভব করে তোলার মৌলিক মূল্যবোধগুলোকেই চ্যালেঞ্জ করে বসছেন। তারা ধ্যান-ধারণার অবাধ আদান-প্রদানের নীতির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীকারকে কাজে লাগিয়ে এমন সব বক্তব্য বা ভূমিকাকে হাজির করছেন যা সামগ্রিকভাবে সমাজের ভিত্তির উপর হুমকি। তারা অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছে। ‘ইহুদীরা আমাদের স্থান নিতে পারবে না’ এই স্লোগান তুলে শার্লোটসভিলে মশাল হাতে নব্য নাৎসিদের মিছিল এরই এক চরম দৃষ্টান্ত মাত্র। রিচার্ড স্পেন্সার ও কোন্টারের বক্তব্য ছিল আরেক রকম। কোন্টার তার ব্যাপক পরিসরে অপমান করার ক্ষমতা নিয়ে বড়াই করেছেন। আর স্পেন্সার মনে করেন শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। এসব বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে বিতর্কের ক্ষেত্রে তেমন তো কোন অবদান রাখেই না বরং ঘৃণা সঞ্চার করে। তাই বক্তব্য উঠেছে যে, অসহিষ্ণু বক্তৃতা প্রতিহত করতে হবে। আবার পাল্টা বক্তব্য উঠেছে যে, অসহিষ্ণু বক্তৃতায় বাধা দেয়াও একটা অসহিষ্ণুতা, সুতরাং সেই অসহিষ্ণুতাও প্রতিহত করতে হবে। বরং রক্ষা করতে হবে সেই পরিবেশ, যেখানে সবার অবস্থান ও মর্যাদা সমান এবং সেখানে সবাই অবাধে নিজের ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করতে এবং আদান-প্রদান করতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে আমেরিকার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিতর্ক হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলো ইয়ানোপৌলাসের বক্তৃতা দিতে আগমন নিয়ে তুলকালাম কা- হয়েছিল। সেন্ট্রাল প্লাজায় ছাত্ররা বহ্ন্যুৎসব করে। ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে ঝটিকা হামলা চালায়। নজিরবিহীন সহিংসতার মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ক্যাম্পাস পুলিশ মিলোর উপস্থিতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। অনেকের কাছে মনে হয়েছে, ছাত্ররা বর্ণগত অবিচার, বৈষম্য ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আবার সমালোচকদের মতে ছাত্ররা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। এমন এক অসহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে যা বিরোধী বা অজনপ্রিয় বক্তব্যের বিরোধী। বিক্ষোভকারীরা কি অবাধে বক্তব্য প্রকাশের অধিকারকে স্তব্ধ করতে চায়, নাকি তাদের বক্তব্যই অন্যদের শোনানোর চেষ্টা করছে? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি অবাধ বক্তব্য প্রকাশের অধিকার রক্ষা করতে চায়, নাকি তা দমন করতে চায় সেটার ওপরই আজ সবার দৃষ্টি। সূত্র : টাইম
×