ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ ॥ কেউ হবে না জয়ী

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩০ আগস্ট ২০১৭

চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ ॥ কেউ হবে না জয়ী

যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ১৪ আগস্ট মার্কিন মেধাস্বত্ব চুরির ব্যাপারে চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক তদন্ত ঘোষণা করেছেন। হোয়াইট হাউস থেকে বার বার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল যে চীনের একের পর এক অসদাচরণের কারণে আমেরিকার তরফ থেকে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করা হবে। ১৪ আগস্টের ঘোষণা সেই চাপ সৃষ্টিরই নামান্তর। অনেকে আশঙ্কা করছিলেন যে বাণিজ্য নিয়ে সংঘাত দ্রুত বিস্তার লাভ করবে এবং তাতে দু’পক্ষেরই দারুণ ক্ষতি হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্টতই জয় হবে। তাদের এমন মনে হওয়ার একটা কারণ হলো এই যে আমেরিকার তুলনায় চীনের ঝুঁকি অনেক বেশি। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডরারেরও বেশি। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র চীনে মোট ১১৫৬০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৬২৬০ কোটি ডলার। চীনের জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান প্রায় ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তা ৩০ শতাংশের কম। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ হ্রাস পেলে তুলনামূলকভাবে চীনেরই ক্ষতি। চীনের দুর্বলতার আরেক কারণ এর ঋণ। দেশটির প্রবৃদ্ধি গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত মন্থর হয়ে চলেছে। সরকার এই মন্থরতা কমিয়ে গতি বাড়াতে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে। সরকারী ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে এই ঋণের অঙ্ক নতুন বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। গত জুন মাসে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স নামে ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান জানায় যে চীনের মোট ঋণের পরিমাণ এখন জিডিপির ৩০৪ শতাংশেরও বেশি। চীনের মতো মাথাপিছু কম আয়ের একটি দেশের জন্য এই অঙ্কটা নজিরবিহীন। চীন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাগুলোর কয়েকটি ইতোমধ্যে হারিয়ে বসেছে। এক সময় চীন শুধু শ্রম দিয়ে যে পরিমাণ মূলধন সৃষ্টি করতে পারত আজ প্রযুক্তির বদৌলতে সেটা করতে পারে না এবং করেও না, একই সময় চীনা শ্রমের দামও বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে যে চীনে ইউনিট প্রতি শ্রমের খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৪ শতাংশ কম ছিল। আজ ইউনিট প্রতি উৎপাদনের দিক দিয়ে চীনের তুলনায় জাপানে কারখানা শ্রমিকদের মজুরি কম। চীনের জন্য এটা বিশেষভাবে জটিল এক মুহূর্ত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ আমেরিকার জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক হবে এবং তা থেকে দেশটি লাভবান হবে মনে করার কারণ নেই। বস্তুতপক্ষে দু’দেশের বাণিজ্য থেকে আমেরিকা উল্লেখযোগ্য সুফল পেয়েছে। দেখা গেছে যে চীনে আমেরিকার শীর্ষক ক্যাটাগরির রফতানি পণ্যগুলো সাধারণত উচ্চমূল্য সংযোজিত যা যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের মুনাফা নিয়ে আসে। চীনে রফতানির কারণে আজ আমেরিকায় প্রচুর চাকরির সৃষ্টি হয়েছে যার সংখ্যা ২৬ লাখ। চীনে মার্কিন রফতানি কমে গেলে বেকারত্ব বাড়বে বৈ কমবে না। চীন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নতুন বিনিয়োগ করে চলেছে এবং বর্তমানে তার হাতে আমেরিকার ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ট্রেজারি বন্ড বসেছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে এক দশকেরও বেশি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে এবং তার পরও অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছে সেটা চীনের এই বন্ড ক্রয়ের ফলে এক অর্থে সম্ভব হয়েছে। চীন-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক থেকে লাখ লাখ আমেরিকান লাভবান হয়েছে। দু’দেশের বাণিজ্য যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতিতে তারা এখন চাকরি হারাবে, জীবিকা হারাবে। বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাশুল বহন করা মার্কিন অর্থনীতির পক্ষে হয়ত সম্ভব হবে না।প্রশ্ন উঠতে পারে চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধে কার বেশি ক্ষতি হবে? কেউ বলে স্বল্পমেয়াদী বিচারে চীনের বেশি ক্ষতি হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিচারে বিশেষ করে চীনের অর্থনীতির বলিষ্ঠ অবস্থা এবং প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বিশাল সম্ভাবনা বিচারে আমেরিকার ক্ষতি হবে অনেক বেশি। ট্রাম্পের এটা বোঝা উচিত যে চীন সেই সব রাজ্যে অবস্থিত মার্কিন কোম্পানি ও শিল্পগুলোকে টার্গেট করে তার যা করার তার যথাসাধ্য করবে যেখানে ভোটারের সমাবেশ বেশি এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভিত্তি আছে। কোথায় আঘাত করলে ট্রাম্পের সবচেয়ে বেশি লাগবে সেটা চীনারা ভাল মতোই জানে। এক কথায় বলা যায় এই যুদ্ধ থেকে কারও লাভ হবে না, কেউ বিজয়ী হবে না। সূত্র : টাইম
×