ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমিত সম্ভাবনার হাতছানি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৭ আগস্ট ২০১৭

অমিত সম্ভাবনার হাতছানি

শংকর লাল দাশ পায়রা সমুদ্রবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের এক বছর পূর্ণ হলো ১৩ আগস্ট। গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের এ দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পায়রা সমুদ্রবন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। গত এক বছরে এ বন্দর দিয়ে নিয়মিত পণ্য খালাস হয়েছে। সফলতার সঙ্গে এক বছর পূর্ণ করার মধ্যে দিয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর যে ভবিষ্যতে অমিত সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। সুকঠিনভাবে আরও প্রমাণিত হয়েছে দক্ষিণের এ সমুদ্রবন্দর একদিন দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে রূপ নেবে, এবং এর প্রয়োজনীয়তা আজ বাস্তবতা। তাই তো-শুধু সমুদ্রবন্দরই নয়, এটি কেন্দ্র করে এর আশপাশে বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে বেশ কিছু মহাপরিকল্পনা। ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে, এমন পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে অনেক। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যেরও হবে পরিবর্তন। কর্মসংস্থান হবে অসংখ্য মানুষের। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের রামনাবাদ চ্যানেলের পশ্চিম তীরে পায়রা সমুদ্রবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ঠেকসই উন্নয়নের একটি দৃষ্টান্তনীয় মাইলফলক। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়োকচিত দীর্ঘ চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন। ‘পায়রা’ সমুদ্রবন্দর নামকরণও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর দেশে বন্দর ব্যবহার ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দরের কর্মক্ষমতা সে হারে বাড়ছে না। এ অবস্থায় ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলে তৃতীয় সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর অংশ হিসেবে কুয়াকাটাকে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের কারণে তৃতীয় সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠনের পর বেশ জোরের সঙ্গে সমুদ্রবন্দর স্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়। বেশ কয়েক দফা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সমীক্ষার পরে রামনাবাদ চ্যানেলে সমুদ্রবন্দরের স্থান নির্ধারণ করা হয়। মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় রামনাবাদ চ্যানেলের গভীরতা অনেক বেশি। সরাসরি বন্দরে মাদার ভেসেল নোঙরের সুযোগ রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে সাত হাজার একরের বেশি ভূমিজুড়ে নির্মিত হচ্ছে পায়রাবন্দর। এতে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। বন্দরের মূল অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বর পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজের এবং ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট পণ্য খালাস কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়রা সমুদ্রবন্দর শুধু স্থানীয় বা জাতীয় নয়, আঞ্চলিক অর্থনীতির জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই দেশটির জন্য এক মহাসুযোগ এনে দিয়েছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর বঙ্গোপসাগরের এমন জায়গায় অবস্থিত, যার আশপাশের দেশগুলোর অনেক অঞ্চল পুরোপুরি ভূমিবেষ্টিত। সমুদ্রে প্রবেশে সহায়ক সুযোগ নেই। ট্রানজিট সুবিধার আওতায় নেপাল, ভুটান এবং ভারত পায়রা সমুদ্রবন্দর অনায়াসে ব্যবহার করতে পারবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা অথবা তামিলনাড়ুসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে বয়ে আনা মালামাল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দূরবর্তী সাতটি রাজ্য অসম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মণিপুর ও অরুনাচলে সহজে পৌঁছানো সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে অনেক ক্ষেত্রেই সিঙ্গাপুরের পরে হবে কুয়াকাটা সমুদ্রবন্দরের অবস্থান। পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় এমন বেশকিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়ক পর্যন্ত পাঁচ দশমিক ৬০ কিলোমিটার চারলেন বিশিষ্ট সড়ক নির্মাণ। ২৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কটির নির্মাণ কাজ আগামী বছর শেষ হবে। এর পাশাপাশি সড়ক পথে দ্রুত পণ্য আনা-নেয়ার জন্য কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করা হবে। সড়কের পাশাপাশি নৌপথে পণ্য আনানেয়ার জন্য রামনাবাদ, বুড়াগৌরাঙ্গ, তেঁতুলিয়াসহ অন্যান্য নদীগুলো খনন কাজ শুরু হয়ে গেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান আবাসিক ও শিল্পের বৈদ্যুতিক চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ৬টি কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। তার মধ্যে পায়রাবন্দর তীরবর্তী এলাকায় চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্লান্ট নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এছাড়া, পায়রাবন্দরের কাছাকাছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৫ হাজার মেগাওয়াট ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও দুটি পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের প্রস্তাব বর্তমানে সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকায় প্রাণীজ ও খনিজ সম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি অবল¤¦ন করে পায়রা সমুদ্রবন্দরের আশেপাশে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও রফতানিকরণ এলাকা গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওষুধ শিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ওষুধ রফতানি যেমন দ্রুততর হবে, তেমনি কাঁচামাল আমদানিও সহজ হবে। এ কারণে পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি বেসরকারী খাতে ইতোমধ্যে ওষুধ শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পায়রা বন্দরের কাছাকাছি রাঙ্গাবালী উপজেলার চরজাহাজমারায় পরিবেশবান্ধব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পায়রাবন্দর ঘিরে সবুজ বেষ্টনীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তৈরি হচ্ছে ইকোপার্ক। যেখানে বন্যপ্রাণীর জন্য থাকবে অভয়ারণ্য। সমুদ্রবন্দর ঘিরে তৈরি হবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল। গড়ে উঠবে বিশেষ রফতানি অঞ্চল। বন্দর সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখানে তৈরি হবে তেল শোধনাগার ও সার কারখানা। দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দরের পাশে তৈরি হচ্ছে আধুনিক নৌঘাঁটি। এখানে এভিয়েশন, জাহাজ ও সাবমেরিন বার্থিং সুবিধা থাকবে। এ ঘাঁটি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যবর্তী হওয়ায় নেভাল এভিয়েশন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকায় নজরদারি করা সহজ হবে। নৌবাহিনী এ ঘাঁটির মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সুন্দরবন ও আশপাশ এলাকায় অপরাধ দমনে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সাধারণ জনগণের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করারও সুযোগ হবে। পরিকল্পনায় সমুদ্রবন্দর কেন্দ্রিক পর্যটন ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সোনারচর, চরজাহাজমারা, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র নিয়ে গড়ে তোলা হবে ‘একান্ত পর্যটন এলাকা’। পর্যটন এলাকায় পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হবে হোটেল-মোটেল। বেসরকারী খাতে গড়ে তোলা হবে ফাইভস্টার মানের হোটেল। ব্যবসা ও পর্যটন সুবিধার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর গড়ে তোলারও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে কুয়াকাটায় দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগসহ গ্রহণ করা অন্যান্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে গোটা দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দক্ষিণাঞ্চল হবে যার কেন্দ্রবিন্দু। স্থাপন হবে ডজন ডজন শিল্প কারখানা। ঘটবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। দক্ষিণাঞ্চলে হ্রাস পাবে বেকারত্ব। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে মানুষের। এরইমধ্যে বেশকিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা মহাসড়কের আশপাশে জমি কিনতে শুরু করেছেন। ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে জমির দাম। বিভিন্ন খাতে শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থান হতে শুরু করেছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, পায়রা সমুদ্রবন্দরের কল্যাণে এক সময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষও ছুটবে উন্নয়নের মহাসড়কে।
×