ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিয়ায় নিহত আইএস জঙ্গী সুজনের অর্থ পাচারের নেটওয়ার্ক

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ আগস্ট ২০১৭

সিরিয়ায় নিহত আইএস জঙ্গী সুজনের অর্থ পাচারের নেটওয়ার্ক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সিরিয়ায় নিহত বাংলাদেশী আইএস জঙ্গী সাইফুল ইসলাম সুজনের অর্থপাচার ও জঙ্গী অর্থায়নের আন্তর্জািতক নেটওয়ার্কের সন্ধান মিলেছে। এফবিআইয়ের একটি নথির বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বৃহস্পতিবার খবর দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, সুজনের এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে বাংলাদেশী কোন কোন জঙ্গী ও কোন জঙ্গী সংগঠন বা কোন ব্যক্তির সরাসরি যুক্ত থাকার বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সুজনের নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের মতাদর্শে বিশ্বাসী বাংলাদেশী জঙ্গী সংগঠন গুলশান হামলায় জড়িত নব্য জেএমবির কোন যোগাযোগ ছিল কিনা তা জানতে তদন্ত চলছে। সুজন পেইপ্যাল নামে যে বিদেশী কোম্পানির নামে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করত, সেই একই কোম্পানির মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়ন ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জন সম্প্রতি সিআইডি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবরে জানানো হয়েছে, দীর্ঘদিন নজরদারির পর ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অভিযান চালায় এফবিআই। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় মোহাম্মদ আলশিনাওয়ি নামের ত্রিশ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন আইএস সদস্য। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে জঙ্গীদের অর্থ পাচার নেটওয়ার্কের নতুন তথ্য। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বাল্টিমোরের ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি। সেখানে বলা হয়, আলশিনাওয়ি ইবের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রিন্টার বিক্রির নাটক সাজিয়ে পেইপ্যালের মাধ্যমে আইএসের নেটওয়ার্ক থেকে অর্থ নেন। ওই অর্থ সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল। ফেডারেল আদালতে এফবিআইয়ের দেয়া এফিডেভিটের বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে আইএস নেটওয়ার্ক যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশেও টাকা পাঠিয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন আইএসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশী কম্পিউটার প্রকৌশলী সাইফুল হক সুজন। আইএসের এই নেটওয়ার্কে যুক্ত বেশ কয়েকজন পরে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে গ্রেফতার বা নিহত হন বলে এফবিআইয়ের এফিডেভিটে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় আইএসের কথিত রাজধানী রাকার কাছে ড্রোন হামলায় নিহত হন সুজন। যুক্তরাজ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করা সুজন আইএসের কম্পিউটার অপারেশন বিভাগের প্রধান ছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীদের দাবি। সুজনের স্ত্রী ও বোন এখনও নিখোঁজ। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মোতাবেক, সুজনের বাড়ি খুলনার পাকুড়তিয়া গ্রামে। ভাই শরীফুল হক ইমন ও দুই ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানরা বেশ কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। সিরিয়ায় সুজনের নিহত হওয়ার সপ্তাহ দুই আগে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার কারওয়ানবাজারে তার প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস টেকনোলজিস লিমিটেডের কার্যালয় অভিযান চালায় পুলিশ। ওই কার্যালয় থেকে সুজনের বাবা একেএম আবুল হাসনাত, ছোট ভাই হাসানুল হক ওরফে গালিব মাহমুদসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে জঙ্গী অর্থায়নে সহযোগিতার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ। তেজগাঁও থানায় দায়েরকৃত ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, গ্রেফতারকৃত ওই পাঁচজন জঙ্গী সংগঠনের সদস্য বা সমর্থক। বিদেশে থাকা সুজন ও তার ভাই জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আইব্যাকসের মাধ্যমে তাদের টাকা পাঠিয়ে আসছিলেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, সুজনের বাবা কিছুদিন আগে কারাগারে মারা যান। সুজনের ভাই বর্তমানে জামিনে। জানা গেছে, এ্যাপ ও ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস টেকনোলজিসের মূল কার্যক্রম চলত যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ থেকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, জর্দান, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছিল। ওই ব্যবসার আড়ালে সুজন অর্থ পাচারে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। আইব্যাকসের মাধ্যমে সুজন কয়েক লাখ পাউন্ড ঢাকা হয়ে সিরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন বলে সে সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রগুলো। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়ার পাশাপাশি প্রিন্টার কনফিগার করে দেয়ার কাজও করত সুজনের কোম্পানি। কিন্তু ওই কোম্পানির নামে ১৮ হাজার ডলারে একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান থেকে মিলিটারি গ্রেড সার্ভেইলেন্স ইক্যুইপমেন্ট কেনা হয়েছিল বলে তথ্য পেয়েছেন এফবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিতে তারা আড়িপাতা সরঞ্জাম খুঁজে বের করার যন্ত্রপাতি কেনার অর্ডার দিয়েছিল, যা পাঠানোর কথা ছিল তুরস্কে। এফবিআইয়ের এফিডেভিটে বলা হয়েছে, আইএসের এই নেটওয়ার্ক থেকে মোট ৮ হাজার ৭শ’ ডলার পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলশিনাওয়ি। এর মধ্যে পেইপ্যালের মাধ্যমে পাঁচটি পেমেন্ট তিনি পেয়েছিলেন সুজনের কোম্পানির কাছ থেকে। আলশিনাওয়ি ওই অর্থ একটি ল্যাপটপ একটি সেল ফোন ও ভিপিএন কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক কেনার পেছনে খরচ করেন। আইএস নেটওয়ার্কে যোগাযোগের জন্য ওইসব যন্ত্রপাতি তিনি ব্যবহার করতেন। আইএস নেটওয়ার্কের দেয়া অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনার কথা জানতেন বলে এফবিআইয়ের কাছে স্বীকার করেছেন আলশিনাওয়ি। তবে তিনি নিজে কোন হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন না বলে জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন। গত সোমবার রাতে হবিগঞ্জ থেকে জঙ্গী অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয় মোস্তাক আহম্মেদ খাঁ (২৭)। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, এক সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা মোস্তাক তুরস্কের একটি মাদ্রাসায় প্রায় ছয় বছর পড়াশুনা করার সময় পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। তুরস্কের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হয়ে কাজ করে দেশে ফিরে। নিজেই এনজিও খুলে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে জঙ্গী কর্মকা- চালানোর কাজে ব্যয় করত। তার নামে থাকা বিভিন্ন এ্যাকাউন্ট ও এনজিওর মাধ্যমে অর্থ আসত। ইসলামী ব্যাংকের হবিগঞ্জ শাখায় থাকা মোস্তাকের এ্যাকাউন্টে ২০১৪-১৫ সালেই দুই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। একই রকম অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে মোস্তাকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাউসার মিয়া (২৬) ও তার শাশুড়ি হামিদা খাতুনের (৫৮) ব্যাংক এ্যাকাউন্টেও। মোস্তাকের সঙ্গে সিরিয়ায় নিহত সুজনের কোন যোগাযোগ ছিল কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ভুয়া মাস্টার কার্ড তৈরি করে অর্থ পাচার ও জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগে গত ৮ আগস্ট রাজধানীর হাজারীবাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসকার ইবনে ইসহাক শাকিল (২৪), ঢাকা কলেজের ছাত্র রিয়াজুল ইসলাম ওরফে ইমরান (২২), তিতুমীর কলেজ থেকে পাস করা সৈয়দ মেহেদী হাসান (২৯), ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র জহিরুল হক (২৫) ও কেরানীগঞ্জের বিকাশ ও ফ্ল্যাক্সি লোডের ব্যবসায়ী হায়দার হোসেন (৩০) গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে ১৪১টি মাস্টার কার্ড ও নগদ নয় লাখ সাড়ে ২১ হাজার টাকা, ইসলামী ব্যাংকের সিল, ৩২টি ব্যাংক চেকসহ নানা আলামত উদ্ধার হয়। সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃতরা ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে মাস্টার কার্ড তৈরি করে। এসব মাস্টার কার্ড তৈরি করে দেয়ার সঙ্গে স্ক্রিল, পাইওনিয়ার, নেটেলার, ফাস্টচয়েজ, পেইপ্যাল, পারফেক্ট মানি, ওয়েব মানি ও বিট কয়েন নামের কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান জড়িত বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে যে ১৪১টি প্রিপেইড মাস্টার কার্ড উদ্ধার হয়েছে, তা পাইওনিয়ার কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসে। এসব মাস্টার কার্ডে অর্থ পাচারকারী ও জঙ্গী অর্থায়নকারীদের চাহিদা মোতাবেক ডলার রিচার্জ করে দিচ্ছে চক্রের সদস্যরা। এসব কার্ড নিয়ে বিদেশ গিয়ে অর্থ পাচার করে আসছে। আবার একইভাবে বিদেশ থেকে এসেও কোন কোন ব্যক্তি কার্ডের মাধ্যমে আনা অর্থ দেশের জঙ্গীবাদে ব্যয় করছে বলে তারা ধারণা করা হচ্ছে। যে পেইপ্যাল কোম্পানির মাধ্যমে সুজনের জঙ্গী অর্থায়ন করার তথ্য বেরিয়েছে, সেই পেইপ্যাল কোম্পানির নাম এসেছে সম্প্রতি জঙ্গী অর্থায়ন ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সিআইডির হাতে গ্রেফতারকৃত ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদে।
×