ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এখানে আমরা সবাই এক

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৫ জুলাই ২০১৭

এখানে আমরা সবাই এক

হেলেন লিদিয়া মিরেন একজন ব্রিটিশ অভিনেত্রী। তিনি তাঁর অভিনয় শুরু করেন ‘রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানি’ দিয়ে ১৯৬৭ সালে এবং তিনি এমন একজন অভিনেত্রী যিনি দুবার মনোনয়নের পর ২০০৭ সালে ‘দ্য কুইন’ সিনেমায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের চরিত্রের জন্য একাডেমি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপা জেতার পর ‘ট্রিপল ক্রাউন অফ এ্যাক্টিং’ পুরস্কার জিতেছেন। ২০১৫ সালে তিনি, দুবার মনোনয়নের পর, ‘দ্য অডিয়েন্স’ নাটকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের চরিত্রের জন্য টনি শ্রেষ্ঠ নাট্যাভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেন। পিটার মগার্ন ‘দ্য অডিয়েন্স’ এবং ‘দ্য কুইন’- দুটিরই লেখক। মিরেন একাধিকবার এমি পুরস্কারের মধ্যে প্রথমবার জেতেন আইটিভি সিরিজ ‘প্রাইম সাসপেক্ট’-এ পুলিশি গোয়েন্দা জেইন টেনিসন চরিত্রের অভিনয়ের জন্য। হেলেন মিরেন লন্ডনের হ্যামারস্মীথে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ভাসিলি পেট্রোভিচ মিরোনফের, মা আলেকজান্দ্রিয়া ইভা মাটিল্ডা। তার মা ব্রিটিশ এবং তার বাবা রাশিয়ান ছিলেন। মিরেন হ্যামলেট কোর্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘ওয়েস্টক্লিফ-অন-সী’তে ভর্তি হয়েছিলেন যেখানে তিনি নাটক ‘হান্সেল এ্যান্ড গ্রেতেল’-এর মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন। সেন্ট বের্নার্ড মেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয় ‘সাউথএ্যান্ড-অন-সী’তেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। তারপর তিনি লন্ডনের টিচিং কলেজ ‘নিউ কলেজ অফ স্পিচ এ্যান্ড ড্রামা’তে যোগদান করেন। আঠারো বছর বয়সে তিনি জাতীয় যুব থিয়েটার (নিউইয়র্ক টাইমস) জন্য অডিশন দেন এবং পেয়েও যান। ২০ বছরের মধ্যে তিনি ওল্ড ভিক-এ নিউইয়র্ক টাইমস প্রযোজিত ‘এ্যান্টনি এ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’ নাটকে ক্লিওপেট্রা চরিত্রে অভিনয় করেন। শিল্পকলায় তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০৩ সালে তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের রীতি অনুযায়ী ‘ডামে’ উপাধি দেয়া হয়। ২০১৩ সালে হলিউড ‘ওয়াক অফ ফেম’এ মিরেনকে একটি স্টার দেয়া হয় এবং ২০১৪ সালে বাফটা মিরেনকে ‘একাডেমি ফেলোশিপ’ সম্মান দেবে ঘোষণা করে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টুলেইন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদান করেন হেলেন। তার সমাবর্তন ভাষণের উল্লেখ যোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো- প্রিয় শিক্ষার্থীরা, অবশেষে তোমরা পেরেছ! ক্লাস, প্রবন্ধ, আলোচনা, লেকচার, কম্পিউটারের সঙ্গে একেকটা বিনিদ্র রাত কাঁটিয়ে ... সব পেরিয়ে তোমরা আজকের দিনে পৌঁছেছ। সব শেষে আর একটা মাত্র মানুষের কথা তোমাদের শুনতে হবে, সেই মানুষটা আমি। তবে আমি চেষ্টা করব আমার বক্তব্যটা যেন ‘লেকচার’ হয়ে না যায়। ভয় নেই, তোমাদের সামনে কথা বলব বলেই আগের থেকে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি আমি। আমি অভিনয়ের শুরুর থেকে প্রতিটি চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমি রীতিমতো গবেষণা করি। চরিত্রটি খুব ভালমতো বুঝে নিই। রেড ছবিতে সিক্রেট এজেন্টের চরিত্রের জন্য যেমন গুলি চালানো শিখেছিলাম। রানীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শিখেছি, কীভাবে তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আর টিচিং মিসেস টিঙ্গেল ছবিতে একজন বাজে শিক্ষকের চরিত্র রপ্ত করার জন্য গিয়েছিলাম এলএসইউতে কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরাই সব শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তোমাদের হয়ত জানতে ইচ্ছা করছে আজকের দিনের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিলাম? অনেক চিন্তা করে দেখলাম, একজন সমাবর্তন বক্তার কাছ থেকে শ্রোতারা আসলে কী শুনতে চায়। হাজারো পরামর্শ পাওয়া গেল, তবে মূল কথা মাত্র তিনটি। প্রথমত, বক্তব্য ছোট রাখা। আধঘণ্টার লম্বা বক্তৃতা কেউ শুনতে চায় না। দ্বিতীয়ত, তোমার জীবনের গল্পটা এমনভাবে বলবে, যেন শ্রোতারা নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। দুর্ভাগ্যবশত আজকের সমাবর্তন বক্তার সঙ্গে শুধু সেই নিজের মিল খুঁজে পাবে। তৃতীয়ত, সমাবর্তন বক্তার এমন একটা কথা বলা উচিত, যাতে শ্রোতারা তাঁর কথাটা অন্তত ৪০ বছর মনে রাখে। অনেক ভেবেচিন্তে এমন একটা কথা আমি খুঁজে পেয়েছি। আশা করি ২০৫৭ সাল পর্যন্ত এটা তোমাদের মনে থাকবে। কথাটা হলোÑ ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার কিংবা ওভাল অফিস, যেখানেই তুমি থাক না কেন, রাত ৩টার সময় টুইট করাটা কোন কাজের কথা না! রাত ৩টা প্রসঙ্গে মনে পড়ল, নিউ অরলিন্সে ফিরে আসতে পেরে সত্যিই ভাল লাগছে। এখানে আমি কখনই রাত ৩টার আগে ঘুমাতে পারিনি। গত কয়েক দিন এই ক্যাম্পাসের আনাচ-কানাচে ঘুরে তোমাদের জন্য একটা প্রশ্নই আমার মাথায় এসেছেÑ কোন্ দুঃখে তোমারা স্নাতক সম্পন্ন করছ? এত সুন্দর একটা জায়গা ফেলে বাইরে গিয়ে চাকরি-বাকরি খোঁজার কী দরকার আমি বুঝি না! এখনও দেরি হয়ে যায়নি। ডিনকে বল, তোমার ডিগ্রিটা রেখে দিতে, আর নিজের ধর্মে ফিরে যাও! জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে আমি যা শিখেছি, সেসবের মধ্য থেকে কিছু কথা আমি তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। তোমরা একে বলতে পার, সুখী জীবনের জন্য হেলেনের পাঁচ পরামর্শ। প্রথম পরামর্শ- বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ো না। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে আমি টেইলরকে বিয়ে করেছি এবং এর সুফল পাচ্ছি। সব সময় তোমরা তোমাদের জীবনসঙ্গীকে তাঁর জীবনের লক্ষ্যটা পূরণ করতে সাহায্য কর। দ্বিতীয় পরামর্শ- মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখ। অনেক অনেক দিন আগে আমার এক অভিনেত্রী বন্ধু খুব সহজ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমাকে শিখিয়েছিল। বন্ধুটি আমার ধূমপান করত। একবার আমরা একসঙ্গে ট্যাক্সিতে করে শূটিংয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে ধূমপান করার ব্যাপারে সেই সময় কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। প্রতিদিনের মতো আমার বন্ধুটি একটা সিগারেট ধরাল এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়ির চালককেও একটা সিগারেট সাধল। খুব সাধারণ একটা কাজ। কিন্তু ভেবে দেখ। সে কিন্তু গাড়ির চালককে ‘গাড়িচালক’ ভাবেনি, ‘মানুষ’ ভেবেছে। আজকের দিনে এ কাজ করলে হয়তো ‘হত্যাপ্রচেষ্টার’ অভিযোগে ওর জেল হয়ে যেত! কিন্তু এই শিক্ষাটার জন্য আমি আমার বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ। ঘটনাটা আমি কখনও ভুলব না। অতএব মনে রাখবে ‘তোমার ওপর কারও আধিপত্য থাক বা না থাক, সমপরিমাণ সম্মান ও বিনয় প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য। দ্বিতীয় পরামর্শটির সঙ্গে আরেকটি কথা যোগ করতে চাই। তুমি যে গোত্রের হও না কেন, নারীবাদী হও। বহু দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ আমি দেখেছি। সুইডেন থেকে উগান্ডা, সিঙ্গাপুর থেকে মালি সব জায়গার ক্ষেত্রেই একটি কথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত’ নারী যদি তাঁর প্রাপ্য সম্মান বুঝে পান, তাহলে পুরো জাতিই তার সুফল ভোগ করে। তৃতীয় পরামর্শ- তুমি দেখতে কেমন, তার ওপর নির্র্ভর করে কেউ যদি তোমাকে বিচার করে, তাকে পাত্তা দিও না। বিশেষ করে সে যদি মনিটরের পেছনে লুকিয়ে থাকা কোন চরিত্র হয়। আর তুমি নিজেই যদি একজন মনিটরের পেছনে মুখ লুকিয়ে রাখা ইন্টারনেটে আসক্ত মানুষ হওÑ বন্ধ কর! বাইরে গিয়ে অন্তত একটা কাজের কাজ করো।
×