এম শাহজাহান ॥ আগামী কোরবানি ঈদের চামড়া সংরক্ষণে এখনও প্রস্তুত হয়নি সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। ধীর গতিতে চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। এতে কোরবানি ঈদের ৩৫-৪০ লাখ পিস কাঁচা চামড়ার ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঝুঁকিতে পড়েছে এ শিল্প খাতের ১০ হাজার কোটি টাকার বাজার। চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ সম্পন্ন করতে আবারও সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান। পানি ও বিদ্যুত পাওয়া গেলেও গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। ১৫৪ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬২টিতে চামড়া উৎপাদন শুরু করেছে। ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করেছে ৭৭ প্রতিষ্ঠান। আর কারখানা চালুর জন্য ৭২ প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের জন্য আবেদন করেছে। মাত্র ২০ প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে তিতাস। এছাড়া পানির সংযোগ নিয়েছে ৫৫ প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাজারীবাগের ট্যানারি স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার পর সাভারে কারখানা সরতে শুরু করেছে। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া হচ্ছে ধীরগতিতে। তাই আগামী কোরবানির সময় সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। শিল্পমালিকরা বলছেন, ব্যবসায়ই তো বন্ধ রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় এবারের কোরবানির চামড়া নিয়ে কোন প্রস্তুতি নেই মালিকদের। আর সাভারের চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানি ঈদের আগে যাতে অন্তত ১০০ শিল্প প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি চালু করা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়াকেই তারা সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে সরায় বুড়িগঙ্গা দূষণের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেলেও সাভারের ধলেশ্বরী ফের দূষণের কবলে পড়েছে।
এদিকে, কাঁচা চামড়ার ওপর ভর করে দেশের অভ্যন্তরে চামড়াজাতপণ্য শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। চামড়ার সঙ্গে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন বিশেষ করে স্যান্ডেল, জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, পার্সসহ নানা ধরনের পণ্য রফতানি হচ্ছে। গার্মেন্টসের পর রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে এ শিল্পের অবস্থান। টাকার অঙ্কে বছরে দেশে-বিদেশে এ শিল্পের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। চলতি বছরে চামড়া বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু নানামুখী সমস্যায় এ শিল্পে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদে প্রয়োজন হয় লবণের। সেই লবণের দাম এখন প্রতিকেজি ২৫-৪০ টাকা। কোরবানি ঈদের আগে লবণের দাম না কমলে চামড়া সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হবে। পচে চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি কাঁচা চামড়ার বাজারে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে লবণ আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদার ও বেপারি ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, সাভার চামড়া শিল্পনগরীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ধীরগতিতে হওয়ার কারণেই চামড়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বছরের ৫০ শতাংশ চামড়া আসে কোরবানি ঈদের সময়। কিন্তু কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এখনও অর্ধেক কারখানা প্রস্তুত হয়নি। ফলে ওই সময় সংগৃহীত কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদ নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সিইটিপি নির্মাণের জন্য আবারও সময় বাড়ানোর আবেদন করায় চীনা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের এই আবেদন প্রকল্প থেকে ইতোমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাভার চামড়া র্শিল্পনগরী প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মোহাম্মদ জিয়াউল হক জনকণ্ঠকে বলেন, সিইটিপি নির্মাণের জন্য চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে দুটি চালু করা হয়েছে। চালু ২ ইটিপি দিয়ে আপাতত বর্জ্য পরিশোধনের কাজ চলছে। তিনি বলেন, হাজারীবাগ থেকে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হওয়ার পরই কেবল উদ্যোক্তারা দ্রুত সাভারে স্থানান্তরের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তারপরও কাজ চলছে ধীর গতিতে। তিনি বলেন, ৬২ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে গেছে, বাকি প্রতিষ্ঠান অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করতে পারেনি। তবে কোরবানি সামনে রেখে ইতোমধ্যে কারখানা চালুর ব্যাপারে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের যত দ্রুত সম্ভব গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির সংযোগ দেয়া হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, কোরবানি ঈদের আগে ১০০ প্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব হবে।
তথ্যমতে, ১৫৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৭ ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ১৪৩ প্রতিষ্ঠান স্থায়ী বিদ্যুতের জন্য আবেদন দিয়েছে। ১০০ প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুত সমিতি বরাবর ডিম্যান্ড নোটের টাকা জমা দিয়েছে। আর কারখানা চালুর জন্য ৭২ ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থায়ী বিদ্যুত সংযোগ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা রয়েছে গ্যাসে। কারণ গ্যাস সঙ্কটের কারণে তিতাস কর্তৃপক্ষ আবেদন করার পরও সংযোগ দিতে পারছে না । ইতোমধ্যে ২০ ট্যানারিতে মিটার স্থাপন করে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। ৬ ট্যানারিতে গ্যাস সরবরাহের জন্য মিটার স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া ৮ ট্যানারিতে সার্ভিস পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। ৬ ট্যানারিতে মেটারিয়াল ইস্যু ভাউচার (এমআইভি) প্রদান করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সাভারে পানি ও বিদ্যুত নিয়ে তেমন কোন সমস্যা নেই। তবে চামড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে গ্যাসের তা কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সংযোগ চাইলেও দেয়া হচ্ছে না। তাই আগামী কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদ পরিস্থিতির বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। তিনি বলেন, কোরবানিতে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে পারবে না। একদিকে অবকাঠামো নির্মাণে টাকা খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে কারখানা প্রস্তুত নয়। এই বাস্তবতায় কেউ চামড়া কিনবে না। তিনি বলেন, পোস্তার আড়তদার ও বেপারিরাই এখন ভরসা। আড়তমালিকরা চাইলে চামড়া কিনে তা মজুদ করতে পারবে। তিনি বলেন, কোরবানির আগে কোনভাবেই সব কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় চামড়া ব্যবসার ঝুঁকি আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, দ্রুত ব্যাংক ঋণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে এ শিল্পখাত রক্ষা করা যাবে।
সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে নির্মাণাধীন কারখানা মেসার্স লিয়েন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহ্ এমরান পাটোয়ারী সম্প্রতি বলেন, আমাদের কোন কারখানায় এখন পর্যন্ত গ্যাস ও পানির সংযোগ লাগেনি। কয়েকটি কারখানায় মাত্র বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। তাই কারখানা চালু করা সম্ভব হয়নি। কারখানা চালু করতে গেলে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুত; এ তিনটি সংযোগ সবার আগে প্রয়োজন হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। প্রথম দফায় প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১০ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। তাতেও কাজ শেষ হয়নি। আবারও ২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেকে। এ সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিসিক। শিল্পনগরে ২০৫ প্লটে ১৫৫ কারখানা স্থাপন করার কথা রয়েছে।
এদিকে, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এবং শিল্পনগর প্রকল্পের কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন, সিইটিপির নির্মাণকাজের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। চীন-বাংলাদেশ যৌথ প্রতিষ্ঠান জেএলইপিসিএ-ডিসিএল জেভিকে ২০১২ সালের ১১ মার্চ চামড়াশিল্প নগরে সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। শর্ত ছিল, ১৮ মাসে কাজ শেষ করতে হবে। ওই মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। এরপর তাদের সময় দেয়া হয় এ বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। তবে বিসিক সূত্র বলছে, খুবই নগণ্য পরিমাণে কাজ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে সময় বাড়ানোর জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে।
শিল্পকারখানায় কাজের বাস্তবায়ন
সাভারে নির্মাণাধীন চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। কয়েক দফা সময় দেয়ার পরও রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় কারখানা স্থানান্তর করতে পারছেন না ট্যানারি মালিকরা। সাভারে প্লট বরাদ্দের জন্য ইউনিট নির্ধারণ করা হয় ১৫৫, এর মধ্যে দেয়া হয়েছে ১৫৪। মামলাজনিত কারণে একটি প্লটের বরাদ্দপত্র জারি করা হয়নি। তাই লে আউট প্ল্যান অনুমোদন করা হয়েছে ১৫৪টির। বর্তমান কারখানার মূল ভবনের কাজ শুরু করেছে ১৫১ প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে একটি এবং ভূমি বরাদ্দ কমিটি চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছে দুটি প্লট। এছাড়া কারখানা ভবন বাস্তবায়নে ৬ষ্ঠ ও ৫ম তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে একটি, দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই ও ছাদ আংশিক সম্পন্ন করতে পেরেছে ২৭ প্রতিষ্ঠান, ৫২ প্রতিষ্ঠান এক তলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া ১ তলার ছাদ আংশিক সম্পন্ন করেছে ৩৯। পাইলিং করে গ্রেটবিম ও কলাম ঢালাই করেছে ৮, পাইলিং কাজ চলমান একটি, বেজ ঢালাই করে গ্রেটবিম ও কলাম ঢালাই করেছে ১৬ এবং বেজমেন্ট করার মাটি খনন করেছে একটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া চতুর্থ তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে দুটি এবং তৃতীয় তলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই করতে পেরেছে ৩ প্রতিষ্ঠান।
কাঁচা চামড়ার লবণের দাম বাড়ানোর কারসাজি হচ্ছে
কোরবানির সময় গরু ও ছাগল হতে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ পিস কাঁচা চামড়া আসবে। এই চামড়া সংরক্ষণে লবণের প্রয়োজন হবে ৩০ হাজার মেট্রিক টনের। ইতোমধ্যে কোরবানি সামনে রেখে লবণের দাম বাড়ানোর কারসাজি করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ৫ লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিলেও সেই লবণ কোরবানির আগে আনার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে কোরবানিতে লবণের সঙ্কট তৈরি হবে-এ ধরনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এবার লবণের অভাব ও দাম বাড়ার কারণে কাঁচা চামড়ার বাজারে ধস নামতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান। জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, চামড়া বাঁচাতে আমরা ৩০ হাজার মেট্রিক টন লবণ আমদানির অনুমতি চেয়েছি। এই লবণ দেয়া না হলে এবার কাঁচা চামড়া রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ২৫-৪০ টাকা দরে লবণ কিনে কেউ চামড়া সংরক্ষণ করবে না। আর কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়া না হলে তা পচে যাবে। এ কারণে দ্রুত লবণ আমদানির অনুমতি দিতে হবে।
বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী
সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীর দুটি সিইটিপি থেকে ছাড়া পানিতে বিপর্যস্ত ধলেশ্বরী নদী। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঠিকমতো পরিশোধন না করেই পানি ফেলা হচ্ছে নদীতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে বর্জ্য শোধনের সক্ষমতা নেই এই সিইটিপি’র। এমনকি ডাম্পিং ইয়ার্ড না থাকায় সাভারের পরিবেশ হাজারীবাগের চেয়েও ভয়াবহ হবার শঙ্কায় তারা। উজানে তৈরি পোশাক কারখানার ময়লা পানি আগে থেকেই দূষিত করেছে ধলেশ্বরী নদীকে। তবে দূষণের তীব্রতা বেড়েছে হরিণধরা পয়েন্টে। ধলেশ্বরীর এই তীরেই গড়ে উঠছে চামড়া শিল্পনগরী। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে নষ্ট হয়েছে মাছের আধার। জীবিকায় আঘাত পড়েছে নদীনির্ভর মানুষের। পরিবেশ অধিদফতর গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ধলেশ্বরী নদীর পানি ও সিইটিপি থেকে বের হওয়া বর্জ্য পরীক্ষা করে ক্ষতিকর ১১ উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি দেখতে পেয়েছে। এর মধ্যে আছে পানির তাপমাত্রা, ক্ষারের পরিমাণ, দ্রবীভূত অক্সিজেন কম থাকা, বিদ্যুত পরিবাহন, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, জৈব রাসায়নিক উপাদান। ধলেশ্বরীর পানি ও সিইটিপি থেকে বের হওয়া বর্জ্য পানি দুটির নমুনা পরীক্ষা করে এসব উপাদান মানমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। ফলে শিল্পনগরীর নিয়ম না মেনে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) চালুর অভিযোগ তুলেছে পরিবেশ অধিদফতর। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মোহাম্মদ আলমগীর সম্প্রতি জানান, পরিবেশ অধিদফতরে পরীক্ষা না করিয়ে পানি ধলেশ্বরীতে ফেলার বিষয়টি আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। পানি পরীক্ষা করে দূষণের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টিও তাদের লিখিতভাবে বলেছি। তারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা পরিবেশ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।
নানা ধরনের চ্যালেঞ্জেও চামড়া রফতানি বেড়েছে
বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৯ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা)। যা একই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাকের পরই রফতানিতে শীর্ষ দ্বিতীয় পণ্যের তালিকায় আছে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে এ খাতে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য দেয়া হয়েছে।
এদিকে, চামড়ার তৈরি সামগ্রীর ফ্যাশন কখনও পুরনো হয় না। বাংলাদেশের তৈরি চামড়াসামগ্রীর বিদেশেও চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের লেদার মানের দিক থেকে অনেক উন্নত। গুলশান ডিসিসি এক নম্বর মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররমসহ বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্সে চামড়াসামগ্রীর দোকান রয়েছে। চক বা মোগলটুলিতেও রয়েছে লেদার বেল্ট, মানিব্যাগসহ বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। অভ্যন্তরীণ বাজারেও দিন দিন লেদার সামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে।
হাজারীবাগ ট্যানারিমুক্ত করাই সরকারের বড় সাফল্য
শিল্পমন্ত্রী হিসেবে আমির হোসেন আমু দায়িত্ব নেয়ার পরই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেন। যদিও ট্যানারি সরানোর জন্য মালিকদের কয়েকদফা আল্টিমেটাম দেয়া হলেও তা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে পুরো বিষয়টি চলে যায় আদালতের ওপর। ট্যানারি সরাতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা জরিমানাও গুনতে হয়েছে ট্যানারি মালিকদের। অবশেষে আদালতের নির্দেশেই পরিবেশ অধিদফতর হাজারীবাগের ট্যানারি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়। এখন হাজারীবাগ ট্যানারিমুক্ত-এটাই সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সাভারে ট্যানারি যাচ্ছে, এটাই তো বড় অর্জন। কয়েক যুগ ধরে এ নিয়ে পরিবেশবাদীরা চিৎকার করছেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। বুড়িগঙ্গা গেছে, হাজারীবাগে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। অবশেষে সেই ট্যানারি সরে যাচ্ছে সাভারে। তিনি বলেন, সাভারের পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে এখন বেশি যতœশীল হতে হবে। চামড়া রফতানিতে দ্বিতীয় প্রধান শিল্পখাত। অর্থনীতিতে এই পণ্যটির গুরুত্ব অনেক। তাই চামড়া শিল্প উন্নয়নে আরও ভাল পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সাভারের চামড়া শিল্পনগরী সরকারের একটি বড় সাফল্য। চামড়ার মতো দেশে অন্যান্য পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধিতে পৃথক নগরী হওয়া প্রয়োজন।
চামড়াকে বর্ষপণ্য হিসেবে মর্যাদা
চলতি ২০১৭ সালে বর্ষপণ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়ার পর এবার চামড়া খাত উন্নয়নে রোডম্যাপ দিতে যাচ্ছে সরকার। এ শিল্প খাত উন্নয়নে এ পর্যন্ত সরকারের গৃহীত বর্তমান কার্যক্রম, ভবিষ্যত প্রত্যাশা ও অঙ্গীকারসমূহ নিয়ে এই রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। রোডম্যাপের আওতায় এ শিল্পের টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে। দেশে একটি সুনিয়ন্ত্রিত, সুপরিকল্পিত এবং পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প দেশে গড়ে উঠবে। এতে আগামী পাঁচ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে এ শিল্পখাত থেকে। রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সবুজ অর্থায়ন, মানসম্পন্ন কাঁচা চামড়ার যোগান নিশ্চিতকরণ, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠন, দক্ষ জনবল প্রস্তুত এবং বিজ্ঞানসম্মত পশুপালন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। নতুন শিল্পনগরীতে ট্যানারি শিল্প পুরোদমে চালু করতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে অবকাঠামো খরচ বাবদ ব্যয় হবে ৩ হাজার কোটি এবং বাকি ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে শুধু মেশিনারিজ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। সহজশর্তে গ্রীন ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে এই তহবিল গঠন করা হবে।
শীর্ষ সংবাদ: