ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্য অর্জনে রাজধানীর আধুনিকায়নের পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের

যানজটে ঢাকায় দিনে নষ্ট হয় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২০ জুলাই ২০১৭

যানজটে ঢাকায় দিনে নষ্ট হয় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যম আয়ের লক্ষ্য অর্জনে ঢাকার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। যানজটের কারণে ঢাকায় দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিগত ১০ বছরে যান চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে এসেছে। যানজট পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ভবিষ্যতে যান চলাচলের গতি মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতির ( ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার) চেয়েও কমে যাবে! এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পথের দিশাও দিয়েছে সংস্থাটি। সেটি হলো ঢাকার সম্প্রসারণের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা। এর অংশ হিসেবে দুই সিটির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হওয়া পূর্বাঞ্চলের ১৬টি ইউনিয়নে পরিকল্পিত নগরায়ণের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি এসব নতুন এলাকা যুক্ত হওয়ায় ঢাকা সিটির আয়তন ১২৯ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে ২৭০ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। তবে ঢাকার দুই মেয়র বলেছেন, ঢাকার আধুনিকায়ন করতে হলে সবগুলো সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনকে সিটি গবর্মেন্টে (নগর সরকার) পরিণত করতে হবে। বুধবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘টুওয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা : ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট অপশনস ফর ঢাকা টুওয়ার্ডস ২০৩৫’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য ও পরামর্শ তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা, ইউই লী। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মেয়র আনিসুল হক ও মোঃ সাঈদ খোকন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং ভারতের দিল্লীর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের তরফে উপস্থাপিত ‘টুওয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ শীর্ষক খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার নগরায়ণ কেন্দ্র থেকে উত্তর দিকে এবং এরপর পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। মহানগরীর পূর্ব দিকে বেশিরভাগ এলাকা এখনও গ্রামীণ; তবে দ্রুত বিকাশ লাভের সুযোগ রয়েছে। মহানগরীর প্রায় ৪০ শতাংশের সমান পূর্ব ঢাকা, গুলশানের মতো সমৃদ্ধ এলাকার ৫ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত, যা আর্থিক ও মানবসম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নে সহায়তা করতে পারবে। যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ব ঢাকা নানা সুবিধাসহ বিভিন্ন কর্মকা-ের একটি প্রাণচঞ্চল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে এবং তা শহরের অন্যান্য অংশের ভিড় ও যানজট কমাতে সহায়ক হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকা-ে সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। ফলে একটি বিশৃঙ্খল ও অসম নগরায়ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ অনেক অধিবাসী প্রায়ই মৌলিক সেবা, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঢাকার রাস্তা ৫ শতাংশ, জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ এবং যান চলাচল ১৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ যানজট ও বাসযোগ্যতার পরিবেশের আরও অবনতি ঘটাবে এবং বাসিন্দারা বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। প্রতিবেদনে সতর্ক করে দেয়া হয়, সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে, পূর্ব ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়ণ যানজট ও বসবাসযোগ্য পরিবেশের আরও অবনতি ঘটাবে এবং বাসিন্দারা বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। ক্ষোভ ঝাড়লেন আনিসুল হক অনুষ্ঠানে উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিশ্বব্যাংক ভাল পার্টনার, কিন্তু লেইট ডিসিশন মেকার। ২০১৭ সালে এসে বিশ্বব্যাংক ২০৩৫ সালের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু ২০১৭ সালের ঢাকা কেমন হবে সেই বিষয়ে এতদিন কোন গবেষণা-পর্যালোচনা বিশ্বব্যাংক কেন করেনি? জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় নিলে সাংহাই, টোকিও, সিঙ্গাপুর, ক্যানবেরা, দিল্লী এসব শহরের সঙ্গে ঢাকার তুলনা করে লাভ নেই। এখানে নাগরিক সেবাদানকারী বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এখানে সমস্যা হলো জনসংখ্যা ও ট্রাফিক। আমাদের অনেক প্রস্তুতি দরকার। প্রয়োজন সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের অংশগ্রহণ। নগর সরকার চাইলেন সাঈদ খোকন মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীতে এখনও পরিকল্পিত ড্রেনেজ, সুয়ারেজ, অবকাঠামো নেই। আমাদের তহবিলের সংকট আছে। ৫৬ সেবা খাত ঢাকায় কাজ করছে। কিন্তু এদের মধ্যে সমন্বয় নেই। নতুন রাস্তা নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যে ওয়াসা, বিদ্যুত বিভাগ, বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ নিজেদের কাজে রাস্তা কাটার আবেদন করে। ফলে একই রাস্তা বার বার মেরামত করতে হয়। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ সিটি গবর্নমেন্টের কথা বলেছিলেন। আমিও মনে করি ঢাকার নাগরিক সমস্যা সমাধান করতে হলে সিটি কর্পোরেশনকে সিটি গবর্নমেন্ট করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের রাজধানী হবে ঢাকা অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাকে ঘিরে নেয়া সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকাকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশের রাজধানী এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের রাজধানী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশ দ্রুত এগুচ্ছে। আর ঢাকা তারচেয়েও দ্রুত এগুচ্ছে। ঢাকার আয়তন দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ ভাগ। অথচ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৬ শতাংশ আর আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ৪২ শতাংশ ঢাকার অবদান। ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক নগরবাসীর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন বিদ্যুত সুবিধা, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণ চ্যালেঞ্জ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ঢাকার আয়তন ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ১২৭ বর্গমাইল থেকে ২৭০ বর্গমাইলে উন্নীত করেছে। রাজধানীর মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা সক্রিয় আছে। উন্নত নগর গড়তে হলে পুরো শহরের স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। গণপরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য মাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট, বাস র‌্যাপিট ট্রান্সপোর্ট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, উড়াল সড়ক ও নদীভিত্তিক বৃত্তাকার যাতায়ত তৈরির কার্যক্রম চলছে। অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে তিন কোটি ৫০ লাখে। বিপুল এ জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে উৎপাদনশীল ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সারাবিশ্বের বিভিন্ন উন্নত মহানগরীর উদাহরণ টেনে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা বলেন, পূর্ব সাংহাইয়ের পুডং এলাকা ও অন্যান্য স্থান প্রমাণ করে যে, যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে যানজট নিরসন সম্ভব। ঢাকার বিশাল ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবেচনায় যথাযথভাবে পূর্ব ঢাকার টেকসই উন্নয়ন, অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে রেট্রোফিট টেকনোলজি (এমন একটি প্রযুক্তি যেটা দিয়ে পুরানো ভবন না ভেঙ্গে যথাযথ শক্তিশালী করা) ব্যবহার করা। এ প্রযুক্তি অনেক বেশি কার্যকর এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক। এ কাজ করার সঠিক সময় এখনই। ভারতের দিল্লীতে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত এবং চীনের সাংহাইয়ের সাবেক ভাইস মেয়র কিঝেং ঝাও (ভিডিও বার্তায়) সম্মেলনে দিল্লী ও পূর্ব সাংহাইয়ের পুদং এলাকার উন্নয়নের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। শীলা দীক্ষিত নগর সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দিনব্যাপী সম্মেলনে বেশ কয়েকটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এসব সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উচ্চপর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক, নগর পরিকল্পনাবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বেসরকারী খাতের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সবার পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে এ বছরের শেষের দিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
×