ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মনের আবেগে টিকে আছে রামযাত্রা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৪ জুন ২০১৭

মনের আবেগে টিকে আছে রামযাত্রা

কেশবচন্দ্র ব্যাপারী গাঁয়ের আর দশজনের মতো সাদামাটা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। বয়স ষাট ছাড়িয়েছে। পেশায় পানচাষী। বাড়ির পাশের লাগোয়া জমির বরজে সারা বছর পান চাষ করেন। বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে তা কেনাবেচা করেন। দেহের রং নিখাদ কালো। খাটো গড়নের ধুতি পাঞ্জাবি পরা এ মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তার মধ্যে রয়েছে লোকজ সংস্কৃতির অনুপম শিল্পীসত্তা। সাংসারিক শতেক টানাপোড়নের মাঝেও গান ভালবাসেন। নিজে সুর করেন, অন্যের কণ্ঠে তুলে দেন সে সুরের আবেশ। সঙ্গীতের প্রতি রয়েছে আজন্ম টান। আর এ টানের কারণে তার মতোই গাঁয়ের খেটে খাওয়া নানান বয়সী মানুষদের কাছে টেনেছেন। তাদের নিয়ে গড়েছেন যাত্রাদল। তবে আধুনিক কালের চিরপরিচিত ঢংয়ের যাত্রাদল নয়। গড়েছেন ‘রামযাত্রা’র দল। লোকজ সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জনপদের মানুষের মাঝে আজও গর্ব করার মতো লোক-সংস্কৃতির অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যা হাজার বছর ধরে এ দেশে পদ্মা যমুনাসহ শত নদীর মতো প্রবহমান। ‘রামযাত্রা’ তেমনই আদি লোক-সংস্কৃতির ঐতিহ্যপূর্ণ শাখা। যাত্রা বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠা আলো ঝলমলে চিরপরিচিত দৃশ্য থেকে রামযাত্রার প্রভেদ অনেকখানি। আবার অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে প্রচুর মিল। যাত্রাগান বাংলার মাটি ও মানুষের নিজস্ব গান। যাত্রাগান বাংলার প্রাচীনতম সংস্কৃতি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রাগানের চেয়েও প্রাচীনতম হচ্ছে রামযাত্রা। যাত্রাগানের উৎপত্তি মূলত রামযাত্রা থেকে। রামযাত্রার আঙ্গিক পরিবর্তন করে আধুনিক রূপ দিয়ে যাত্রাগানের প্রচলন করা হয়েছে। রামযাত্রার নামকরণ করা হয়েছে রামায়ণ থেকে। মহাকাব্য রামায়ণের আখ্যান নির্ভর করে যাত্রার ঢংয়ে অভিনয়ের জন্য এর নাম ‘রামযাত্রা’। কেশবচন্দ্র ব্যাপারীসহ রামযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানালেন এর আদ্যপান্ত। রামায়ণ ব্যতীত অন্য কোন কাহিনী নিয়ে রামযাত্রা হয় না। রামযাত্রার দলে সাধারণত কুড়ি থেকে ত্রিশ কুশলী থাকে। এর দশ থেকে বারোজন যন্ত্রী এবং গায়ক। বাকিরা অভিনয় করে। যাত্রাগান রাতের বেলা মঞ্চস্থ হলেও রামযাত্রা দিনের বেলা মঞ্চস্থের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। রামযাত্রায় নারীর ভুমিকায় অভিনয় করেন পুরুষ। যদিও আজকাল কেউ কেউ নারী শিল্পী ব্যবহার করছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। অভিনেতাদের কেউ কেউ একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে। কাঠের তলোয়ার, জরির পোশাক, রাংতা লাগানো মাথার মুকুট, পায়ে ঘুঙুর, এ সবই রামযাত্রার ঐতিহ্য। রামযাত্রার ভাষায় রয়েছে মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম ছোঁয়া। রামযাত্রায় আঞ্চলিক সুর ও ভাষা ব্যবহার করে অধিকতর হৃদয়গ্রাহী করে তোলা হয়। রামায়ণ মহাকাব্যের মূল কাহিনী অক্ষুণœ রেখে ছোট ছোট ঘটনাকে সংশ্লিষ্টরা পালায় রূপ দিয়ে থাকে। এসব পালার নামকরণ করা হয় এভাবে- সীতাহরণ, শক্তিশেল, লবকুশ, রামের বিয়ে, রামলীলা, রাবণবধ, রামভক্ত হনুমান, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, সীতার বনবাস প্রভৃতি। অনেকে আজকাল রামযাত্রার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের আখ্যানও জুড়ে দেয়। পালার পঙক্তি রচনা শৈলিতে পালাকারদের অসাধারণ দক্ষতার প্রমাণ মেলে। এতে পাওয়া যায় আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির গন্ধ। প্রতিটি রামযাত্রার দলে একজন ‘বিবেক’ থাকে। যিনি গানের মাধ্যমে কাহিনী বর্ণনা ছাড়াও উপদেশ দিয়ে থাকে। অভিনয় রীতিতে পুরোপুরি যাত্রার সামঞ্জস্য বজায় রাখা হয়। অভিনয়ের সময়ে প্রায় প্রত্যেক অভিনেতা চরিত্রানুযায়ী গান গেয়ে থাকে। এ জন্য সকলকেই গান জানতে হয়। রামযাত্রার সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় অনুভুতির প্রবল টান রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রধানত হিন্দুদের পারলৌকিক কাজের সময়ে রামযাত্রার আয়োজন করা হয়। অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়েও কমবেশি এর আয়োজন হয়। বাড়ির উঠোনে তাঁবু টানিয়ে এবং নিচে পাটি বিছিয়ে সকালে শুরু হয় রামযাত্রা। যা চলে পড়ন্তবেলা অবধি। আসরের ঠিক মাঝখানে চলে অভিনয়। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×