ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফ্যাশন হাউসের কর্মী থেকে কারুশিল্পী সবাই পার করছেন ব্যস্ত সময়

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১১ জুন ২০১৭

ফ্যাশন হাউসের কর্মী থেকে কারুশিল্পী সবাই পার করছেন ব্যস্ত সময়

রহিম শেখ ॥ ঈদে নতুন পোশাকের চাহিদা বরাবরই একটু বেশি। আর এ চাহিদাকে সামনে রেখে ফ্যাশন হাউসগুলোর কর্মী থেকে শুরু করে তাঁতি, ডিজাইনার, দর্জি, কারিগর, কারুশিল্পীরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। কারো দম ফেলার ফুসরত নেই। পছন্দের প্রিয় পোশাকটি কিনতে রাজধানীর পাঁচ শতাধিক ফ্যাশন হাউস এবং অর্ধশত শপিংমলে ভিড় করছেন ক্রেতারা। নতুন ডিজাইনের বাহারি সব পোশাকের চমক আর চোখ ধাঁধানো বৈদ্যুতিক বাতির ঝলক ক্রেতা আকর্ষণ বাড়াচ্ছে ফ্যাশন হাউসগুলো। গতবারের তুলনায় দাম একটু বেশি হলেও বিদেশী পোশাকের কাছে মার খাচ্ছে এসব ফ্যাশন হাউসের পোশাক। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো বলছে, দেশী বাজার থেকে কাপড় কিনতে না পারার কারণে বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে কাপড় কিনতে হয়। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রচলিত কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশী পোশাকের অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে কম দামে সেগুলো কিনে ক্রেতারা সন্তুষ্ট হন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করে শাহবাগের আজিজ মার্কেট থেকে শুরু করে ধানম-ি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ওয়ারী, মিরপুর রোড, মিরপুর, পল্লবীসহ বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলগুলোর ফ্যাশন হাউসগুলোতে নতুন নতুন পোশাকে কানায় কানায় পূর্ণ। দেশী কাপড় দিয়ে এদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে রুচিশীল ও মানানসই পোশাক তৈরি করেছে ফ্যাশন হাউসগুলো। কাপড় বোনা, কাটিং শেষে পোশাক তৈরি, ডিজাইন ও হাতের কাজ, ব্লক করা, ওয়াশ, আয়রন থেকে শুরু করে প্রত্যেক পর্বের কারিগরদের এক মিনিটের ফুরসত নেই। থ্রিপিস, পাঞ্জাবির সঙ্গে অনুষঙ্গ লেইস, পুঁতি বা পাথরের সমন্বয় করার কাজ নিয়েও ব্যস্ত কারিগররা। কার আগে কে নতুন ডিজাইনের পণ্য আনতে পারবেন এ নিয়ে চলছে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই তাদের ব্যস্ততা বাড়ছে। দেশী এসব ফ্যাশন হাউসে সবচেয়ে বেশি ভিড় করছেন তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর ও মহিলারা। এ প্রসঙ্গে ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের বাহার রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিনিয়ত মানুষের আগ্রহ বাড়ছে দেশী পোশাকের প্রতি। এটা অত্যন্ত ভাল দিক। বিক্রি আগের তুলনায় বেড়েছে বলে তিনি জানান। এ প্রসঙ্গে ফ্যাশন হাউস রঙ-এর কর্ণধার ও ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, এবার যেহেতু গরমে ঈদ পড়ছে তাই ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী ও শিশুদের জন্য পোশাক তৈরি করা হয়েছে। বেচাকেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিক্রি এখনও খুব বেশি জমেনি। তবে আশা করছি সামনের দিনগুলোতে বিক্রি জমে উঠবে। বাংলাদশে ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমতির তথ্য মতে, দেশের ফ্যাশন হাউসগুলোতে বছরে আনুমানিক ছয় হাজার কোটি টাকার পোশাক বেচাকেনা হয়। সারা বছর তাদের যে ব্যবসা হয়, তার অর্ধেকেই হয় রোজার ঈদে। বাকি ১১ মাসে লেনদেন অর্ধেক। জানা যায়, দেশে বড় ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এর প্রত্যেকটির গড়ে ১০ থেকে ১২টি শোরুম রয়েছে। নামী-দামী ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে রয়েছে অঞ্জনস, রঙ, আড়ং, অন্যমেলা, নিত্য উপহার, কে ক্র্যাফট, বিন্দিয়া, নভীনস, তহুস কালেকশন, চরকা, রেডিয়েন্ট ক্রিয়েশন, নভীনস, বিবিআনা, কুমুদিনি, নাগরদোলা, সাদাকালো, শাহরুখস কালেকশন, বাংলার মেলা, নকশা, ওজি, লুবনান, প্লাস পয়েন্ট, টেক্সমার্ট, ক্যাটস আই, লুবনান, ইয়োলো, দেশাল, স্বদেশী ও দেশীদশ। এসব ব্র্যান্ডের পণ্য নিজস্ব শোরুমেই বিক্রি হয়। এর বাইরে ছোট-বড় আরও সাড়ে ৪০০ ফ্যাশন হাউস রয়েছে ঢাকায়। এগুলোরও গড়ে দুই থেকে পাঁচটি শাখা রয়েছে। ফ্যাশন হাউসগুলোর সংগঠন বাংলাদশে ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমতির (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাড়ে চার হাজাররে মতো ফ্যাশন হাউস রয়েছে। তবে অনেক ফ্যাশন হাউসের রাজধানীর বাইরে একটি বিক্রয় কেন্দ্রও নেই। অথচ পাকিস্তান, ভারতীয় পোশাকে বাজার সয়লাব। বিভাগীয়, জেলা শহরে তো আছেই, উপজেলা পর্যায়ের দোকানেও পাওয়া যাবে জরি কন্দল বা পুঁতির কাজ করা ভারতীয় পোশাক। আবার জেলা শহরের শপিংমলগুলোতেও দাপটের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে পাকিস্তানী লন বা ভারতীয় সিরিয়ালের নামের নেটের পোশাক। ফ্যাশন হাউস রঙের কর্ণধার বিপ্লব সাহা বলেন, দেশীয় ফ্যাশন হাউসের তৈরি করা পোশাকের বেশিরভাগই উন্নতমানের কাপড়ে তৈরি হচ্ছে। সুতার মানও ভাল। রঙেও থাকছে স্থায়িত্ব। তারপরও গত কয়কে বছর ধরে ঈদের বাজারের একটি অংশ দখল করে নিচ্ছে ভারত-পাকিস্তান থেকে আসা নানা ধরনের পোশাক। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুই হারিয়ে যাবে। জানা গেছে, এবারের ঈদ বাজারে বিভিন্ন ফ্যাশনের সালওয়ার কামিজের সঙ্গে যোগ হয়েছে সিঙ্গেল কামিজ। সাধারণত বাজারে যে টু-পিস বা থ্রি-পিস পাওয়া যায় তা থেকে সিঙ্গেল কামিজ একটু ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত সিঙ্গেল কামিজের প্যাটার্ন কিছুটা ভিন্ন হয়। গলায় ভারি কাজ, স্ক্রিন প্রিন্টেড বা সুতার ভারি কাজ দিয়ে নক্সা করা থাকে। কিছু আবার ডাবল পার্টের সিঙ্গেল কামিজের নক্সাও পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি ফ্যাশন হাউস ও শপে দেখা যাচ্ছে নানা ডিজাইনের সিঙ্গেল কামিজ। সিম্পল ও গর্জিয়াস দু’ভাবেই তৈরি করা হয়েছে এসব কামিজ। লং, এক্সট্রা লং এমনকি ফ্লোর টাচ ডিজাইন প্রাধান্য পেয়েছে কামিজের প্যাটার্নে। গরমের কথা মাথায় রেখে লিলেন ও সুতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তবে এক্সক্লুসিভ পোশাকগুলোতে নেট, বিভিন্ন ধরনের জর্জেট, মসলিন- এসব উৎসবধর্মী কাপড়ও ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন ডিজাইন ভেরিয়েশনে রয়েছে সালোয়ার কামিজের বিশাল সম্ভার। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের ডিজাইনাররা জানান এবারের ঈদ সালোয়ার-কামিজের আয়োজন থাকছে বেশি। সালোয়ার কামিজ সেকশনে সিঙ্গেল কামিজকে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দর্জি বাড়ির শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, সেমি সিøম পাঞ্জাবি সিল্ক ও কটন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা, কটন ক্যাজুয়াল সিøম প্রিন্ট শার্ট ১৪৯০-১৬৫০ টাকা, ডি পলো টি-শার্ট ১৩৫০ টাকা, উন্নতমানের গেভারটিন ১৬০০-১৮০০ টাকা, ক্যাজুয়াল জিনস ১৬০০-২৫০০ টাকা, পায়জামা ৭০০-১২০০ টাকা, বেল্ট ১০০০-১৮০০ টাকা। দর্জি বাড়ির বিক্রয়কর্মী শেখ মান্নান হোসেন টুটুল জানান, রমজানের শুরুতে বিক্রি ভাল হয়নি। ঈদ যত সামনে আসবে বিক্রি তত বাড়বে। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য নতুন নতুন অনেক কালেকশন আনা হয়েছে বলে তিনি জানান। ইজিতে সিøম ক্যাজুয়াল প্রিন্ট শার্ট ১২৫০-১৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক কালার সিøম শার্ট ১২৫০-১৩৫০ টাকা, কারচুপি পাঞ্জাবি ২২৯০-২৫৮০ টাকা, ওভারট্রিন প্যান্ট ১৪৯০ টাকা, ক্যাজুয়াল জিনস প্যান্ট ১৯৮০-২৪৮০ টাকা. থ্রি কোয়ার্টার ৬৯০ টাকা, টি-শার্ট এক কালার ৬৯০ টাকা, পলো টি-শার্ট ৮০০-৯০০ টাকা, ফরেন টি-শার্ট ১১৯০-২৪৮০ টাকা। গোল গলা এক কালার টি-শার্ট ৩৯০ টাকা, প্রিন্ট ৫০০ টাকা, গোল গলা স্পেশাল টি-শার্ট ৫৯০ টাকা। ইজি’র সহকারী ম্যানেজার মোঃ রাসেল শরীফ জানান, ইজিতে এবার নতুন নতুন ডিজাইনের সব আইটেম রাখা হয়েছে। ক্রেতারা এসে তাদের পছন্দের কাপড় খুব সহজেই নিতে পারছে। তবে এখনও পুরোপুরি ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়নি। প্লাস পয়েন্টের বিক্রয়কর্মী মোঃ সেলিম জানান, ঈদকে সামনে রেখে প্লাস পয়েন্ট এবার পোশাকে অনেক বৈচিত্র্যতা এনেছে। রিচম্যানে গিয়ে দেখা যায় ক্যাজুয়াল শার্ট বিক্রি হচ্ছে ১০৯০-১৫৫০ টাকায়। লিলেন ফেব্রিকের শার্ট ১২৫০-১৯৫০ টাকা, থাই ডেনিম জিনস ৩৫৫০ থেকে ৩৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রিচম্যানের বসুন্ধরা ব্র্যাঞ্চের ইনচার্জ রিজওয়ান কবির জানান, এছাড়া বাইরের অনেক কাপড় রিচম্যানে পাওয়া যাচ্ছে। দাম একটু বেশি হলেও মান অনেক ভাল। তিনি বলেন, রমজানের শুরুতে বিক্রি তেমন ভাল ছিল না। কিন্তু এখন অনেক ভাল হচ্ছে।
×