(পূর্ব প্রকাশের পর)
ময়ূর সিংহাসন
ভরদুপুরে ময়ূরের ডাকে দিবা নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটল সম্রাট শাহজাহানের।
দিল্লী হতে আগ্রায় ফেরার পর আজকাল দৈনন্দিন প্রাত্যহিক কাজগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে করা হচ্ছে না। হবেই বা কি করে। তিনি তো কেবল নামেই বাদশাহ। সব দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন দারার ওপর। আগে নিয়ম করে দিল্লীর লাল কেল্লায় ভোর চারটায় সুবেহ সাদিকের আগে ঘুম ভেঙ্গে যেত। গভীর রাত পর্যন্ত নাচগান, পানাহার তিনি এড়িয়ে চলতেন।
পাথরের ঝর্ণাওয়ালা মুখ-প্রক্ষালনখানা ‘অবসর-ই-তৌফিক’-এ অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। এরপর সকালের নাস্তা সারতেন ঝরোকায় বসে হাম্মামখানায় বাকি বিবিদের সঙ্গে নিয়ে। দিনের প্রথম দুই প্রহর কাটাতেন দিওয়ান-ই-আম এবং দিওয়ান-ই-খাস মহলে। দুপুরে আবার ভরপেট খেয়ে হেরেমে পছন্দের কারও কোলে শুয়ে বিকেল পার করতেন। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে খেতেন আগ্রার প্রসিদ্ধ হেকিমদের বানানো যৌনবর্ধক ‘ভাজিকরানা’ পথ্য।
দাদাজান আকবর হতে শুরু করে সব মুঘল রাজপুরুষের এই পথ্য খাওয়া ফরজ ছিল। মোট ষোলো রকম উপায়ে এই পথ্য বানানো হতো। শাহজাহান যে পদের ভাজিকরানা পছন্দ করতেন তা প্রস্তুত হতো সুঠাম রামছাগলের অণ্ডকোষ দিয়ে। কালো তিল দেয়া গরুর দুধের মধ্যে ভালভাবে সেই অণ্ডকোষ সিদ্ধ করা হতো। এরপর ঘিয়ের মধ্যে ভেজে অল্প শুকনো মরিচ ও লবণ দিয়ে মাখিয়ে তা পরিবেশন করা হতো। নিয়মিত সেবনে দশ বিশ জন তো সাধারণ ব্যাপার, এক সঙ্গে অনুর্ধ এক শ’ জন নারীর সঙ্গেও পূর্ণ সহবাসের শক্তি আর তৃপ্তি পাওয়া যেত।
আজ সম্রাট একটু বেশি মাত্রায় সেই ভাজিকরানা খেয়ে ফেলেছেন। থেকে থেকে গা গুলাচ্ছে তার। রেশম আর ভেড়ার পশমের উল দিয়ে বোনা কাশ্মীরী চাদরের ভেতর হতে যেন আগুনের হলকা বইছে। কানের লতি গরম হয়ে হৃদস্পন্দন ক্রমশ দ্রুত হয়ে উঠছে। শাহজাহান ভেতরের অস্থিরতা কমাতে চেষ্টা করলেন। আগে বিকেলের অবসরে কখনও শতরঞ্জি, কখনও হেরেমের বিবিদের সঙ্গে চৌপর বা কখনও চণ্ডল মণ্ডল খেলতেন। দুর্মুখেরা বলেন, আকবর তার দাসীদের ব্যবহার করতেন শতরঞ্জির হাতি-ঘোড়া সৈন্য সামন্ত হিসেবে। খেলায় হার মানে তাদের সাক্ষাত মৃত্যু। হেরেমখানায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি রোধ বা পুরনো বাইজীদের বিদায় করে দেয়ার কৌশল ছিল সেটা। যদিও শাহজাহান নিজের চোখে তা দেখেননি। কিন্তু ভাবতে ভালই লাগে। এই মুহূর্তে শাহজাহানের ইচ্ছা করছে ষোলোজন দাসী নিয়ে চণ্ডল মণ্ডলের গোলাকার পাশার দান উল্টাতে।
কানের পাশে ময়ূরটা আবার তীক্ষ্ম স্বরে ডেকে উঠল। শাহজাহান কক্ষ হতে বের হয়ে ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দূরে যমুনার তীরে জ্বলজ্বল করছে সাধের তাজমহল। সেদিকে তাকিয়ে নিমিষে শান্ত হয়ে উঠল তার মন। এখন দেহটাকে কেবল মানানো বাকি।
বিকেলের উজ্জ্বল আলোয় যে মুহূর্তে সম্রাট শাহজাহান ষোলোজন বাছাই করা ষোড়শী যুবতী দাসীদের সঙ্গে চণ্ডল মণ্ডল খেলায় ব্যস্ত, ঠিক একই সময়ে শত মাইল দূরে দাক্ষিণাত্যের আওরঙ্গাবাদে শাহজাদা আওরঙ্গজেব তার বাছাই করা যুদ্ধ ও রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে গোপন কক্ষে জরুরী আলোচনায় বসেছেন।
তাদের মধ্যে আছেন সুহৃদ দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খান, একান্ত পরামর্শদাতা শেখ মীর, ব্যক্তিগত সহকারী আকিল খান রাজি, বিশ্বস্ত সচিব কাবিল খান, গোলন্দাজ বাহিনীর পরিদর্শক খান-ই-জামান, প্রবীণ সেনাপতি মুহাম্মদ তাহির, বিশ্বস্ত কূটনীতিক ঈশা বেগ, অভিজাত মুঘল প্রতিনিধি সামস-উদ্দীন-মুখতার খান, প্রিয় উপদেষ্টা ও বীর যোদ্ধা মীর জুমলা, হিন্দু রাজাদের প্রতিনিধি রাও করন, শুভ করন বুন্দেলা, ধামধেরার রাজা ইন্দ্রমণি ও আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুয়াজ্জেম।
উপস্থিত তেরো জনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আওরঙ্গজেব মুখ খুললেন।
- আলহামদুলিল্লাহ! তেরো সংখ্যাটি আমার জন্য খুবই সৌভাগ্যের।
সবাই এক সঙ্গে মাথা নাড়ালেন।
ঘাড় সোজা করে সবাইকে জরিপ করলেন শাহজাদা। এরাই তার মূল ভরসা। এদের মধ্য থেকে যদি কেউ বেইমানি করেন তবে পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। কক্ষে অখণ্ড নীরবতা। এই নীরবতা আওরঙ্গজেবকে স্বস্তি দিল।
আবার বলতে শুরু করলেন শাহজাদা।
- দেখুন দিল্লীর সেই তিন গজ চওড়া লাখ টাকার মণি-মুক্তা বসানো ময়ূর সিংহাসনে বসার লোভে আমি এই পরিকল্পনা করছি না। ঈশা বেগ আপনি বলুন ওই ময়ূর সিংহাসনের বাজার মূল্য কত?
-মহামান্য শাহজাদা আমি যতটুকু জেনেছি প্রায় এগারো কোটি টাকা তো হবেই ...। উপস্থিত সবার মধ্যে সামান্য চাপা গুঞ্জন শোনা গেল। আওরঙ্গজেব নিজেও জানেন মুঘলদের অমূল্য এই ধন ময়ূর সিংহাসন।
-অথচ দেখুন হিন্দুস্তানের ইজ্জতের দাম এর চেয়ে হাজার কোটি গুণ বেশি। এখন যত দেরি হবে তত পিছিয়ে পড়ব আমরা। আপনারাই আমার শক্তি। খোদার কসম দিল্লী দাখিল হলে আমি কাউকে নিরাশ করব না।
এরপর খুব দ্রুত আওরঙ্গজেব কার কি করণীয় ব্যাখ্যা করলেন। ভাড়াটে ইংরেজ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ ও জার্মান গোলন্দাজ সৈন্যদের দায়িত্ব দিলেন মীর জুমলার কাঁধে। সেনাপতি মুহাম্মদ তাহিরকে দায়িত্ব দিলেন ত্রিশ হাজার সৈন্য বাছাই করতে। আওরঙ্গবাদ পাহারায় নিযুক্ত হলেন শাহজাদা মুয়াজ্জেম।
আলোচনায় ঠিক হলো সব ঠিক থাকলে কিছুদিনের মধ্যে রওনা দেবেন বুরহানপুরের উদ্দেশে। সবাইকে জানিয়ে দিতে বললেন অসুস্থ সম্রাটকে দেখতে পুত্রের মহান দায়িত্ব পালন করতে রওনা দিচ্ছেন তিনি। একই সঙ্গে শাহজাদা মুরাদকে পাঠালেন এক সাঙ্কেতিক বার্তা। চারটি শব্দ লেখা ছিল তাতেÑ
‘রুবিকন পাড়ি দিতে চলেছি।’
আওরঙ্গজেবের কাছে দাক্ষিণাত্যের সীমানায় নর্মদা নদী হচ্ছে সেই রুবিকন। যেটা নির্বিঘেœ পাড়ি দিতে পারলে ময়ূর সিংহাসনের এক ধাপ কাছে পৌঁছানো যাবে।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৮ সাল।
আওরঙ্গজেব যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন আগ্রার পথে। ঠিক সেই সময় আগ্রার অদূরে ফতেহপুর সিক্রিতে শাহজাদা দারা গোপন আলোচনায় বসেছেন এক বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি আর কেউ নন। সম্রাট শাহজাহানের পরম শত্রু শিখ ধর্মগুরু হরগোবিন্দ সিংয়ের উত্তরাধিকারী গুরু হর রাঈ সিং।
হর রাঈ সিংয়ের একটাই দাবি। হিমালয়ের অজ্ঞাতবাস ছেড়ে তাকে কিরাটপুরে আশ্রম গড়ার সুযোগ দিলে তিনি আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে দারাকে সহায়তা করবেন। (চলবে)
শীর্ষ সংবাদ: