ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুলতানা মাহবুবা

অপরাহ উইনফে ॥ এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর গল্প

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২ জুন ২০১৭

অপরাহ উইনফে ॥ এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর গল্প

টাইম ম্যাগাজিনের পরিসংখ্যানে বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন সর্বমোট পাঁচবার বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকায় স্থান পান। আর অপরাহ উইনফে টানা আটবার বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকায় ছিলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি টানা আটবার নির্বাচিত হয়েছেন। সামান্য একজন টিভি উপস্থাপক কি করে এতবার বিশ্বের প্রভাবশালী নির্বাচিত হয়েছেন? এই সামান্য পেশাটিকেই অসামান্য করে তোলার পাশাপাশি নিজেকেও নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় অপরাহ উইনফে। মাত্র নয় বছর বয়সে যে কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং এই নির্যাতন সইতে না পেরে একপর্যায়ে বস্তি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ২২ বছর বয়সে এখনকার টিভি মোগল অপরাহ রিপোর্টার হতে চেয়েছিলেন একটি টিভিতে। তখন তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল তার যোগ্যতা নেই বলে। একটি টিভির নিউজ পাঠিকার চাকরি থেকে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন। তিনিই কিনা এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপস্থাপিকা। ১৯৫৪ সালের ২৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার কথিত বাবা পেশায় ছিলেন একজন নরসুন্দর। তার বাবা-মায়ের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না। জীবিকার তাগিদে তার মা তাকে তার নানির কাছে রেখে উত্তরে কাজের সন্ধানে যান। অপরাহ নানির সঙ্গে জীবন শুরু করেন মিসিসিপির একটি ফার্মে। এরপর অপরাহ চলে যান টেনেসির নাসভিভিরেত তার বাবার কাছে। বাবা ভেরনন উইনফ্রে ছিলেন কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মানুষ। তারপরও বাবার কাছে অপরাহ পান একটি নিরাপদ বাসস্থান। ১৭ বছর বয়সে অপরাহ টেনেসির সেরা কালো সুন্দরী নির্বাচিত হন। সুযোগ পান নাশভিলির ডব্লিউভিওএল রেডিওতে। পাশাপাশি তিনি টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পান। যোগ দেন স্থানীয় টেলিভিশনে রিপোর্টার ও উপস্থাপক হিসেবে। এরপর ১৯৭৬ সালে ডব্লিউজেজেড-টিভি নিউজে উপস্থাপক হিসেবে যোগ দিতে চলে যান বাল্টিমোর। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো ‘পিপল আর টকিং’ নামে একটি টক শো উপস্থাপনার কাজ শুরু করেন। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে অন্য শহরেও। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে শিকাগোর ডব্লিউএস-টিভিতে আমন্ত্রণ পান। জনপ্রিয়তায় ধস নামা আধ ঘণ্টার সকালের একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরু করেন তিনি। মাত্র এক বছরে তার মর্নিং শো শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। পরে ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠানটির সময় বাড়িয়ে এক ঘণ্টা করা হয়। প্রচার শুরু হয় ‘অপরাহ উইনফ্রে শো’ নামে। এর এক বছর পর অনুষ্ঠানটি জাতীয়ভাবে সম্প্রচার শুরু হয়। শীঘ্রই উঠে আসে এক নম্বরে। প্রথম বছরের সম্প্রচারের জন্য অনুষ্ঠানটি ‘আউস্ট্যান্ডিং উপস্থাপনা, কথা বলা ও পরিচালনা’ ক্যাটাগরিতে তিনটি ডে-টাইম এ্যামি এ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। একই বছর অপরাহ নিজে অর্জন করেন ইন্টারন্যাশনাল রেডিও এ্যান্ড টেলিভিশন সোসাইটির ‘ব্রডকাস্টার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার। এখন পর্যন্ত অপরাহই সবচেয়ে কম বয়সে ওই পুরস্কারবিজয়ী। ১৯৯৩ সালে পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের সাক্ষাতকার নেন অপরাহ। বিশ্বব্যাপী রেকর্ডসংখ্যক দর্শক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। প্রথমদিকে অন্যান্য টক শোর মতোই চাঞ্চল্যকর গল্প ও জনপ্রিয় অতিথিদের নিয়ে অনুষ্ঠান তৈরি করতেন উইনফ্রে। কিন্তু ১৯৯০ সালে তার অনুষ্ঠানের ধরন পাল্টে যায়। তিনি তার অনুষ্ঠানে জোর দেন আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়বস্তুর ওপর। তার অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা উঠে আসে তুঙ্গে। এই সময়টায় পুরো আমেরিকাই যেন তার প্রেমে পড়ে যায়। এ সময় তিনি অভিনয় করেন সোফিয়া ইন স্পিলবার্গ, দি কালার পার্পল-এ। কালার পার্পলে তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য অস্কার মনোনয়ন পান। নেটিভ সন ছবিতে তার অভিনয়ও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা এবং মানসম্মত বিনোদন অনুষ্ঠানের নির্মাণের ইচ্ছা থেকে ১৯৮৬ সালে গড়ে তোলেন নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হার্পো প্রোডাকশনস। হার্পো বর্তমানে সিনেমা ও টেলিভিশনে প্রযোজনার জগতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ১৯৮৮ সালে তার হার্পো প্রোডাকশনস ‘অপরাহ উইনফ্রে শো’র পূর্ণ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী, যিনি নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের টক শো উপস্থাপনা করেছেন। তার প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি করা হয় টেলিভিশন মিনি সিরিজ ‘দ্য ওমেন অব ব্রেস্টার প্লেস’, টেলিভিশন মুভি ‘ ‘দেয়ার আর নো চিলড্রেন হিয়ার’ ও ‘বিফোর ওমেন হ্যাড উইংস’। দু’টোতেই তিনি অভিনয় ও প্রযোজনা করেন। ১৯৯৬ সালে অপরাহ প্রতিষ্ঠা করেন অন-এয়ার বুক ক্লাব ‘অপরাহ বুক ক্লাব’। তখন থেকে তার বাছাই করা বইগুলো বেস্ট সেলার হতে থাকে। এ কাজের মূল্যায়ন হিসেবে ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের ৫০তম বার্ষিকীতে স্বর্ণপদক পান অপরাহ উইনফ্রে। তিনি নিজেও পাঁচটি বই লিখেছেন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় মাত্র ৩২ বছর বয়সে বিলিয়নিয়ারে পরিণত হন। এছাড়াও তিনি টেলিভিশনে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া পারফর্মার, নিজের প্রচেষ্টায় আমেরিকান নারীদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী, এমনকি আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে ২০ শতকের সবেচেয়ে সম্পদশালী মানুষ। ক্যালিফোর্নিয়ায় ৪২ একর জমির ওপর একটি ওসেন ভিউ বাড়ির মালিক অপরাহ। আরও ছয়টি রাজ্য ও এন্টিগুয়া দ্বীপে তিনি বাড়ি কিনেছেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা বিশ্বের ধনীদের তালিকায় ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন একমাত্র আফ্রো-আমেরিকান। বিশ্বের ইতিহাসে তিনিই প্রথম বিলিয়নিয়ার কালো নারী।
×