ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রজাতি ও বৈচিত্র্যে বিশ্বে বাংলাদেশ অষ্টম

জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে বাঁশ, বাঁশির সুর হৃদয়ে এনে দেয় স্বর্গীয় অনুভূতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৬ মে ২০১৭

জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে বাঁশ, বাঁশির সুর হৃদয়ে এনে দেয় স্বর্গীয় অনুভূতি

সমুদ্র হক ॥ বাঁশ শব্দ দিয়ে যতই গালি দেয়া হোক বাঁশ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। খাদ্য বস্ত্রের পরের স্থানটি দখলে নিয়েছে বাঁশ। বসতবাড়ির জন্য আগে দরকার বাঁশ। তা দালানই হোক আর কাঁচা ঘরই হোক। ছাদ দেয়ার আগে প্রয়োজন বাঁশ। আজও বাঁশকে বলা হয় গরিবের কাঠ। বাঁশের বাঁশি ছাড়া মোহনীয় সুমধুর সুর ওঠে না। নিশুতি রাতে বাঁশের বাঁশির সুর মানব হৃদয়ে স্বর্র্গীয় অনুভূতি এনে দেয়। পৌরণিক উপাখ্যানে আছে- বাদল দিনে নীপবনে কৃষ্ণের বাঁশের বাঁশির সুর রাধাকে ঘর থেকে বের করে এনেছে। রূপক অর্থে বলা যায়- বাঁশ ছাড়া কোন সুরই ওঠে না। ছড়া গান ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই..’ চিরদিনের কিংবদন্তি হয়ে আছে। সেই বাঁশ বাগানের মাথার ওপর এখন চাঁদ দেখা যায় কালে ভদ্রে। দিনে দিনে বাঁশ বাগান উজাড় করে দিয়ে নির্মিত হচ্ছে অবকাঠামো। নিকট অতীতে গ্রামীণ জীবনে বাঁশঝাড় ছিল কোন বাড়ির পরিচিতি দেয়ার সূচক। যেমন- ওই বাঁশঝাড়ের কাছে তার বাড়ি। ছেলেবেলায় বাঁশঝাড় নিয়ে নানি-দাদিদের কাছে কত মজার গল্পই না শোনা যেত। কোন গল্প ভূতের। কোন গল্প ভীতিকর। আবার কোন গল্প প্রীতিকর। এসব গল্প শোনার পর সন্ধ্যা রাতে বাঁশঝাড়ের নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছম ছম করে উঠতো। এরই মধ্যে যদি সামান্য বাতাসে বাঁশে বাঁশের ঠোকাঠুকিতে অন্য ধরনের ধ্বনি ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ হয় তাহলেই হয়েছে। মনের মধ্যে ভৌতিক কা- শুরু হয়। দ্রুত বাড়ি ফেরার পরদিন গল্প গুজবের শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটতে থাকে। যে যেভাবে পারে গল্প বানাতে থাকে। এই গল্প চলতে থাকে অনেকটা সময় ধরে। বাঁশঝাড়ের আরেক পরিচিতি বাঁশের আঁড়া। গ্রামের লোক আজও বাঁশের আঁড়া বলে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো বাঁশ আজও উদ্ভিদের মর্যাদা পায়নি। বাঁশ এক ধরনের ঘাস। মন্দার্থে কোন বাক্য উচ্চারণ অথবা কাউকে গালি দিতে বাঁশের বিকল্প শব্দ বের হয়নি আজও। শুধু ইংরেজী শব্দ ব্যাম্বো। জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে বাঁশের প্রয়োজন হয় না। বলা হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশের প্রয়োজন। নব্বইয়ের দশকে কুড়িগ্রামের উলিপুরে বাঁশের তৈরি পাইপে পায়েচালিত (ট্রেডেল) সেচ নলকূপ উদ্ভাবন হয়। আজও কোথাও বাঁশের ভেতরের গিঁটগুলো ফেলে দিয়ে নলকূপের পাইপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ দিয়ে সেতু বানায়। পুকুর পাড়, খেয়া ঘাট, বাড়ির বহির্আঙ্গিনায় (খুলি) মাচাং, বন্যার সময় আশ্রয়ে বাঁশ দরকার। অবকাঠামো নির্মাণে ছাদের সাটারিং, নির্মাণ হওয়ার পর বাইরে প্লাস্টার ও রং করতে বাঁশ লাগবেই। তোরণ বানাতে, কোন কিছু ঠেকান দিতে ও টেনে আনতে, ঘরের খুঁটি দিতে, বেড়া, চাঁটই, ঘর-গেরস্তালি কুলা, ডালা, ঝুরি অন্যান্য সামগ্রী, কুটির শিল্পসামগ্রী বানাতে বাঁশের দরকার। বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প বর্তমানে রফতানি হচ্ছে। কাগজকলের ম- তৈরির কাঁচামালও বাঁশ। বিশ্ব এগিয়ে যাওয়ার পালায় বাঁশ বড় ভূমিকা পালন করছে। বাঙালী জীবনে বাঁশ চিরন্তন হয়ে আছে। ইহলোকের শেষ ঠিকানা কবরে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চিতায় বাঁশ লাগবেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঁশের প্রজাতি ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। বাংলাদেশে বাঁশের প্রজাতি ৩৩। তবে কোন গবেষকদের মতে, ২৭। দেশী প্রজাতির বাঁশের মধ্যে রয়েছেÑ মুলি, তল্লা, বরাক, ভুদুম, বেথুয়া, বাইজ্জা, লতা, ফারুয়া, করজবা, মাকলা ইত্যাদি। বাঁশগুলোর কোনটির কা- পুরু, কোনওটির লতানো, কোনটি ছাতার মতো ঘন আচ্ছাদন। তল্লা মাকলা ভুদুম বাঁশের কা- পুরু ও কাষ্ঠল হওয়ায় নলকূপের পাইপ, গ্রামীণ সাঁকো, ইমারত তৈরিতে ছাদ দেয়ার আগে ব্যবহার করা হয়। পাহাড়ী এলাকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া বাঁশের কচি কোড়ন দিয়ে সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয়। দেশে বছরে অন্তত ১০ লাখ টন শুকনো বাঁশ ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বাঁশঝাড় উজাড়, অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ হওয়ায় গ্রাম ও বনাঞ্চল থেকে খুব বেশি বাঁশ মিলছে না। বাঁশ প্রজাতিকে রক্ষা এবং বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিলভি কালচার জেনিটিকস বিভাগের অধীনে বাঁশ উদ্যান গড়ে তোলা হয়। সেখানে দেশীয় বাঁশের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা কয়েকটি জাতের রেপ্লিকা হয়েছে।
×