ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হেফাজতী তাণ্ডবের চার বছর আজ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৫ মে ২০১৭

হেফাজতী তাণ্ডবের চার বছর আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আজ রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের তা-বের চার বছর। এসব ঘটনায় সারাদেশে মোট ৮৩ মামলা হয়। মামলার আসামি করা হয় দুই লাখের বেশি লোককে। এরমধ্যে রমনার দুটি ও কলাবাগানের একটি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। বাকি ৮০টি মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তে মূল তা-বকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের আজকের দিনে অবরোধ কর্মসূচী পালন করছিল হেফাজত। কর্মসূচীতে তারা সরকারকে ১৩ দফা ‘ঈমানী’ দাবি জানায়। তা মেনে নিতে সরকারকে আহ্বান জানায়। সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন সাড়া না এলে বিকেলে আচমকা মতিঝিল, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, দৈনিক বাংলাসহ পুরো এলাকায় ব্যাপক তা-ব শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালায়। রাস্তায় থাকা গাছপালাও কেঁটে ফেলে রাস্তা অবরোধ করে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের লাখ লাখ পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, শত শত দোকানপাট, গাড়ি, ভবন পুড়িয়ে দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ, পথচারী ও হেফাজতকর্মীসহ ১৩ জন নিহত হন। এ ঘটনায় শুধু পল্টন মডেল থানায়ই হেফাজতের নেতাকর্মী ছাড়াও বিএনপি-জামায়াতের ৩০০ জনকে এজাহারনামীয় আসামি এবং অজ্ঞাত ৩০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে ৩০টি মামলা দায়ের হয়। এছাড়া মতিঝিল থানায় ৬টি, রমনা থানায় ৩টি, শাহবাগ ও শ্যামপুর থানায় একটি করে মোট ৪১টি মামলা হয়। এছাড়া ব্যক্তি বাদী হয়ে ৩টি মামলা দায়ের করেন। মেট্রোপলিটন এলাকায় মোট ৪৪টি, ঢাকা বিভাগে ৯টিসহ ঢাকায় মোট ৫৩টি মামলা দায়ের হয়। এছাড়া হেফাজতের কর্মসূচীকে ঘিরে সারাদেশে আরও ৩০টি মামলা দায়ের করা হয়। এখন পর্যন্ত ঢাকায় দায়েরকৃত মামলার মধ্যে তিনটি ও চট্টগ্রামে ১টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। এসব মামলায় হত্যাকা-, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, বিস্ফোরক দ্রব্য বহন, সরকারী কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ আনা হয় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ পর্যন্ত এসব মামলায় ৩০ জন গ্রেফতার হয়েছে। এসব মামলার অন্যতম আসামি হিসেবে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তাতে এমন তা-ব আর কর্মসূচীর নেপথ্য কারিগরদের নাম প্রকাশ করে দেয়। যাদের অধিকাংশই ছিল বিএনপি ও জামায়াত নেতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ৫ মে মধ্যরাতে বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাব মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় যৌথ অভিযান চালায়। অভিযানে সাউন্ড গ্রেনেড, লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, রবার বুলেট নিক্ষেপ করে। আতঙ্কে হেফাজতের নেতাকর্মীরা পুরো এলাকা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো এলাকা থেকে সরে যান হেফাজত নেতাকর্মীরা। যাওয়ার সময় তারা টিকাটুলি ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ব্যাপক ভাংচুর চালায়। অভিযান শেষে ব্যাপক প্রপাগান্ডা অভিযানের পর হেফাজতে ইসলামসহ তাদের সহযোগীদের তরফ থেকে আড়াই হাজার নেতাকর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। তার সঙ্গে সূর মেলায় বিএনপি-জামায়াত। শেষ পর্যন্ত তা কমতে কমতে ১৪৭ জনে এসে ঠেকে। শেষ পর্যন্ত নিহত ৬১ জনের তালিকা থাকার কথা দাবি করলেও আজও তাদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করতে পারেনি। এমনকি নিহত ৬১ জনের কারও পরিবারের তরফ থেকে আজও সরকার বা কোন সংস্থার কাছে তার পরিবারের সদস্য হেফাজতের সমাবেশে অভিযানে নিহত হয়েছে বলে দাবি ওঠেনি। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে, পুরো বিষয়টিই ছিল মিথ্যা। মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও অধিকারের এমন দাবি ছিল পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কৌশল হিসেবেই এমন অভিযোগ করা হয়েছিল। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, হেফাজতের মামলাগুলো জটিল। কারণ যারা মাঠ পর্যায়ে থেকে তা-ব চালিয়েছে, তাদের শনাক্ত করা কঠিন ব্যাপার। তারপরেও তাদের খোঁজা হচ্ছে। নাশকতার সঙ্গে জড়িত নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের অফিস পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটিও তদন্তাধীন। মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে। হেফাজতে ইসলাম গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ৬টি উদ্দেশ্য নিয়ে হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে, শিরক ও বিদ্আদ মুক্ত সমাজ গঠন, ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা পালন, সাম্রাজ্য ও পুঁজিবাদসহ সকল মানবীয় মতবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন। হেফাজতে ইসলামের জন্ম ইতিহাস ৬টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলায় হেফাজতে ইসলামের জন্ম হয়। জেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের হযরত শায়খ বর্নভী (রহঃ) এর হাত ধরে হেফাজতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। তখন এর নাম ছিল দ্বীনি জামাতে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম। পাকিস্তানেও দীর্ঘ দিন ধরে এমনই একটি সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৯৫৪ সালে সিলেটের বন্দরবাজার জামে মসজিদে উলামা মাশায়েখদের সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলামের সৃষ্টি হয়। সংগঠনটির প্রথম আমির করা হয় হযরত শায়খ বর্নভী (রহঃ)কে। ওই সময় যৎসামান্য দাওয়াতী কার্যক্রম ও সেবা কার্যক্রমের মধ্যদিয়েই সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছিল। ২০১০ সালে নারীনীতি ও ফতোয়া সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের রায় বাতিলের দাবির প্রেক্ষিতেই সংগঠনটি জোরালোভাবে মাঠে নামে।
×