ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডি.এম তালেবুন নবী

চাঁপাইয়ের জঙ্গী আস্তানার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ৫ মে ২০১৭

চাঁপাইয়ের জঙ্গী আস্তানার নেপথ্যে

সন্ত্রাসের জনপদ শিবগঞ্জের কানসাটের জঙ্গী আস্তানা চিহ্নিত হবার পর গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে উঠে এসেছে ত্রিমোহনীর শিবনগর গ্রামের এই আধাপাকা বাড়িটি ছিল জঙ্গীদের বিস্ফোরকের ভা-ার। এই তথ্যের ভিত্তিতে বড় মাপের তদন্তে নেমেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। কারণ একটাই, বিভিন্ন জায়গা থেকে বিস্ফোরকের সঙ্গে সঙ্গে আর কি ধরনের অস্ত্র গোলাবারুদ মজুদ করা হতো তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরও ধারণা জন্মেছে যে, ইতোপূর্বে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানসহ একাধিক স্থানের জঙ্গী তৎপরতায় যে সব অস্ত্র ভারতীয় এলাকার মধ্যে দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত অতিক্রম করেছিল সেইসব অস্ত্রের মজুদ কি প্রাথমিকভাবে শিবগঞ্জে জঙ্গী আস্তানায় রাখা হয়েছিল? কারণ, শিবগঞ্জের এই জঙ্গী আস্তানার খুবই কাছাকাছি সোনামসজিদ স্থলবন্দর। এছাড়া শিবগঞ্জের মনাকষা, বিনোদপুর, দাইপুকুরিয়া, শ্যামপুর, পাকা, উজিরপুর ইউনিয়নের ২১টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিনিয়ত অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকসামগ্রী প্রবেশ করছে। অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রবেশের এসব পয়েন্ট শিবগঞ্জ জঙ্গী আস্তানার খুবই কাছাকাছি। ত্রিমোহনী থেকে কানসাট মাত্র ছয় মাইলের পথ। কানসাটের পাগলা নদী পার হলেই মনাকষা, শ্যামপুর, বিনোদপুর, পাকা ও উজিরপুরের অবস্থান। পাশাপাশি কানসাট থেকে সোনামসজিদ ও দাইপুকুরিয়া সীমান্ত ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পথ। উভয় সীমান্তপথের সব কটি পয়েন্টের সঙ্গে পাকা পিচঢালা মসৃণ রাস্তা রয়েছে। যেসব পয়েন্টে পদ্মা নদী রয়েছে তা পার হতে ব্যবহার হয় দেশী মেশিনের দ্রুতযান। তবে সবচেয়ে অধিক পরিমাণে অস্ত্র আসে সোনামসজিদ জঙ্গল পোর্ট দিয়ে। এছাড়া বৈধ আমদানি পণ্যের আড়ালে আসে বড় বড় অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের চালান। বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে লেবারদের মধ্যে জঙ্গী সমর্থক। এমনকি অধিকাংশ সময় বন্দরে যারা রাজস্ব বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছে তাদের অনেকে জঙ্গীদের মদদ কিংবা অঢেল পয়সার বিনিময়ে অস্ত্র, বিস্ফোরক আনতে বড় ধরনের সহায়তা দিয়েছে। সিএ্যান্ডএফ এজেন্টদের মধ্যেও ঘাপটিমেরে জঙ্গীদের বহু দোসর রয়েছে। পাশাপাশি কানসাট, মনাকষা, বিনোদপুর, পাকা, শ্যামপুরে জঙ্গীদের বহু সমর্থক রয়েছে। একাধিক ইউপির জনপ্রতিনিধিরা জঙ্গীদের নানানভাবে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এদের অঢেল পয়সা ও গ্রামাঞ্চলে রিসোর্ট টাইপের বাসাবাড়ি রয়েছে। এরাই জঙ্গীদের অর্থের বড় যোগানদাতা হলেও প্রকাশ্যে নেই কোন প্রমাণ। এসব ইউনিয়নের প্রভাবশালীরা সাঈদীকে চাঁদে দেখা ও কানসাট বিদ্যুত কেন্দ্র পোড়ানোর আন্দোলনে নানানভাবে অর্থ যোগান দিয়েছিল। এসব অঞ্চল থেকে হাজার হাজার যুবক ভারতে পালিয়ে গেছে। তারাও নানানভাবে জঙ্গী গোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়ে আসছে। এসব কারণে বহুদিন ধরে আদি ও নব্য জেএমবি সদস্যদের অঘোষিত আখড়া ও বিস্ফোরক ভা-ার পুরো দেশের জঙ্গীদের অস্ত্র, বিস্ফোরক সরবরাহের মূল ঘাঁটি শিবগঞ্জের মধ্যে গড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিক সম্মেলনে বহু ধরনের রাখঢাক তথ্য দিলেও চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জের জঙ্গী আস্তানা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন বিস্ফোরক ভা-ার বা স্টোর হাউস। বহু ধরনের তথ্য সমৃদ্ধ এই গোয়েন্দা প্রধানের দলবল ছাড়াও এখনও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এলাকায় অবস্থান করছে। যার কারণে অভিযান শুরুর প্রথম দিন থেকেই বাড়ির আশপাশে এখনও কাউকে ভিড়তে দিচ্ছে না। ইতোমধ্যেই ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে নজরদারি আগের মতোই রয়েছে। কারণ, এই অঞ্চলে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত আম বাগান রয়েছে। একমাত্র মৌসুম ছাড়া বাগানের মধ্যে কোন মানুষ প্রবেশ করে না বিধায় জঙ্গীরা আম বাগানের ছায়ার নিচে আধা পাকা বাড়িটি বেছে নিয়েছিল বিস্ফোরকের ভা-ার হিসেবে। এলাকা পরিদর্শনকালে উঠে এসেছে আম বাগানের ছায়ার নিচের এই নির্জন বাড়িটির পৌনে এক কিলোমিটার দূরে ত্রিমোহনীর অবস্থান। ত্রিমোহনীর অবস্থান কানসাট-গোমস্তাপুর রাস্তার ধারে। এখানে একটি বাজার ও বেইলি ব্রিজ রয়েছে। বেইলি ব্রিজে উঠার আগে পূর্বমুখী একটি সরু রাস্তা শিবরামপুরে চলে গেছে। এখানকার পাকা রাস্তার ওপর (ত্রিমোহনী) মাঝে-মধ্যে কাভার্ড ভ্যান, ছোট ছোট ট্রাক এসে থামত। গভীর রাতে আসা এসব যানবাহন থেকে মাঝে-মধ্যে বড় বড় প্যাকেট নামাত। আবার কোন সময় দ্রুত বড় বড় প্যাকেট বা বস্তায় ভরা মালামাল এসব যানবাহনে ভর্তি হওয়া মাত্র ছেড়ে যেত। রাতের দিকে মোটরসাইকেল অন্ধকারের মধ্যে পাকা রাস্তা ছেড়ে সরু আম বাগানের নিচের রাস্তা ধরে সেই বাড়িতে গিয়ে থামত। তবে বেশ কিছুদিন ধরে (ছয় মাসের অধিক) বড় বড় যানবাহন আসার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। এখানকার অনেকের ধারণা ত্রিমোহনী বাজারে দোকান খুলে ব্যবসা করার আড়ালে জঙ্গী গোষ্ঠীর সমর্থক থাকতে পারে। এরাই বাগানের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ রক্ষাসহ কোন বহিরাগত আসছে কি-না তার তথ্যাদির খুঁটিনাটি পৌঁছে দিত বাগানবাড়িতে জঙ্গীদের কাছে। এখানে উল্লেখ্য, এই জঙ্গীবাড়ির পেছনে বিশাল আম বাগান শেষে চাষযোগ্য জমির ওপর দিয়ে চলে গেছে ভাতারমারী বিল। খুবই নির্জন এই বিলের ধারে জঙ্গী আবু আর তার অনুসারী অর্থাৎ কাতালপন্থী (সৌদি আরব সমর্থক) জঙ্গীরা তিন মাসে অন্তত দুইবার বড় ধরনের সমাবেশ করত। সন্ধ্যার পর বসত সমাবেশ, চলত সারারাত। এতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জঙ্গী নেতারা নানা ধর্মীয় বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন। এসব দক্ষ বিজ্ঞ জঙ্গী দেশের বিভিন্ন জেলা হতে এসে বক্তব্য রাখতেন। এরা বক্তব্য রাখার সময় নাকি অস্ত্র হাতে দেহরক্ষীরা পাহারা দিত। এ ধরনের বিশেষ সমাবেশে স্থানীয় ও বহিরাগতরা অংশ নিয়ে শেষ রাতে ভূরিভোজ সেরে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেত। বহিরাগতদের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে নাকি পার্শ্ববর্তী দেশের জঙ্গীরা আসত। এমনকি জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের কয়েকদিন আগে পিকনিকের আড়ালে কাতাল জঙ্গীদের বড় ধরনের সমাবেশ হয়েছিল। সেদিন খাবার নিয়ে জঙ্গীদের বড় ধরনের কোন্দল ও ঝগড়াঝাটিও হয়েছিল। জঙ্গী আবু তা ম্যানেজ করে। সোর্স আরও বলছে গোপন এই সমাবেশে আবুর স্ত্রীর সঙ্গে কিছু মহিলাকেই দেখা গেছে। এই নারী জঙ্গী সোমাইয়া বোরকা হেজাবের পাশাপাশি পায়ে-হাতে মোজাও ব্যবহার করত। কাতাল আদর্শের এই নারী স্বামী ছাড়া শ্বশুর, দেবর কারও সামনে মুখ না খুলে হেজাব পরে থাকত। আবুর ছোট ভাই ইসবুরের স্ত্রী রুনা জানান, এসব নিয়ে সোমাইয়ার সঙ্গে পরিবারের ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত। সুমাইয়া মাঝে-মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে মহিলাদের নিয়ে উঠান বৈঠক করত। ৮ বছর আগে কানসাট ইউপির চাপাদাসি মোল্লাপাড়ার রুহুল আমিনের মেয়ে সোমাইয়ার বিয়ে হয়। সোমাইয়ার পুরো পরিবার ও আত্মীয়স্বজন কাতালপন্থী জঙ্গী হবার কারণে তাদের অর্ধসহস্রাধিক নারী-পুুরুষ সদস্য (রুহুল আমিনসহ) জঙ্গী আস্তানায় হানা দেবার পর থেকেই পলাতক রয়েছে। এমনকি আবুর পরিবার, বাবা, ভাইও পলাতক রয়েছে। এরা ধরা পড়লে আরও নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসবে। আবু এক সময় মাদ্রাসার ছাত্র হলেও খুবই মেধাবী ছিল। দাখিল পরীক্ষাতে ইংরেজী বিষয়ে কম নম্বর পাবার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে জঙ্গী হয়ে যায়। আর জঙ্গী হবার পেছনে মদদ জুগিয়েছিল স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তাদের পরামর্শেই শিবনগর গ্রামের জেন্টু বিশ্বাসের নির্জন আম বাগানের মধ্যকার আধাপাকা বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল। চারদিকে সীমানা প্রাচীর ও বাড়ির সামনে-পেছনে দুটি গেট আছে। তাই বহিরাগত জঙ্গীদের বাড়িটি খুবই পছন্দের ছিল। জঙ্গীদের এই আস্তানা ঘিরে গড়ে উঠেছিল একাধিক ইউনিট। এসব ইউনিট পৃথক পৃথকভাবে ভিন্ন ধরনের কাজ করলেও উপার্জিত অর্থ জঙ্গীদের ফান্ডে জমা হতো বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ঢাকার সংবাদ সম্মেলনেও উঠে এসেছে জেএমবি জাল মুদ্রা ব্যবসার আড়ালে সংগঠনকে অর্থায়ন করে থাকে। এই তথ্যের সত্যতাও মিলেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সোনামসজিদে ও তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকার মোহাম্মদপুরে জালনোটসহ মেশিন ধরা পড়ে। প্রথমটিতে সোনামসজিদ বন্দরের কাছাকাছি একটি গ্রাম থেকে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের মেশিনসহ দুই ব্যক্তিকে আটক করে আইন প্রয়োগকারীরা। চলবে... লেখক : সাংবাদিক
×