ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপিকা পান্না কায়সার

পয়ালগাছায় ঋষি বাবার সংস্কৃতিচর্চা

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১ মে ২০১৭

পয়ালগাছায় ঋষি বাবার সংস্কৃতিচর্চা

আমার অতীত বর্তমানে যোজন যোজন দূরে। দুরন্ত গ্রামজুড়ে দস্যিপনার জন্য কত নালিশ। স্কুল ছুটির পর বা ছুটির দিনে চাচা, ফুফু, মামিদের বাড়িতে চড়ুইভাতি খেলায় মেতে উঠতাম। আমার ঋষি বাবা গঙ্গাচরণ বাবুকে রেখে বোনদের গান শেখাতেন। আত্মীয়ের বাড়ি গেলে গান না শুনিয়ে ফিরতে পারতাম না। গাছের ফল চুরি করে চাচাত-মামাত বোনেরা মিলে ঝোপে বসে লবণ মরিচ মেখে কী মজা করেই না খেতাম। আলেয়া, হাছানারা, হোছনা, মোমেনা, হোসায়রা, লিলি, রেবা, মন্তু, রুনু ওদের নিয়ে কী আনন্দময় সময়টা কেটেছে। আমার গ্রাম কুমিল্লা জেলার উল্লেখযোগ্য গ্রাম। কুমিল্লার লোক পয়ালগাছা জমিদার (চৌধুরী) বাড়ি বলত। চৌধুরীদের মধ্যে আমার বাবা মোসলেহ উদ্দীন চৌধুরী ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ জমিদার। বাবা ছিলেন মাইজভা-ারের ভক্ত, মুরিদ। কোন জাগতিক মোহ তাকে টানেনি। মাও তেমনি। বাবা চল্লিশের দশকে শিক্ষায় আলোকিত করার জন্য পয়ালগাছা হাইস্কুলে জমিদারির সম্পদ দান করে স্কুল গড়ার উৎসাহ দিয়েছেন গ্রামবাসীকে। আমার চাচা শামসুদ্দিন চৌধুরী, সেরাজ উদ্দিন চৌধুরীরও এ দানে অবদান আছে। চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারত। এটিই ছিল চৌধুরী বাড়ির আভিজাত্যের নিয়ম। বাবা এ নিয়ম মানলেন না। চৌধুরী বাড়ির নিয়মকে উপেক্ষা করে তিনি আমাদের স্কুলে পাঠিয়েছেন। বোরকা পরে যেতে হয়েছে। তিনি মাইজভা-ারের মুরিদ, সব সময় বৈঠকখানায় ঢোল তবলার শব্দে বাড়ি গম গম করত। কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে ছিলেন খুব খেয়ালি। গ্রামের উন্নয়ন সারাক্ষণ তার মস্তিষ্কে খেলে যেত। তিনি স্কুলেই জমি দান করে স্কুল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করেননি; স্কুলের আয়ের জন্য জমিও দান করেছেন। মাদ্রাসার জন্যও তাই করেছেন। ঋষি বাবা সংস্কৃতিকে ধারণ এবং বিকাশ সাধনে হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াতেন। বিকেল বেলায় বৈঠকখানায় আমাকে, কিচমত ও মায়াপার লালন, ভজনের মাইজভা-ারি গানের শিক্ষা দেয়া হতো। আজ বুঝতে পারি সংস্কৃতির এ চর্চায় আমাদের কতখানি দিয়েছে। জেদ করে স্কুলে গিয়েছি এবং জেদের কারণেই ভাল রেজাল্টও করে ছেড়েছি। শুধু তাই নয়, সেজো বোন কাশ্মির আপাকে ছবি আঁকায়, বাঁশি বাজাতে উৎসাহিত করেছেন বাবা-মা। সন্ধ্যার পর লেখাপড়ার পাঠ চুকলে বৈঠকখানায় চলত আমাদের গানের আসর। মাইজভা-ারি, ভজন, লালন, বাঁশির সুরে বাড়িটি হয়ে ওঠত সাংস্কৃতিক ফল্গুধারার প্লাবণধারা। মা গাইতেন বাবা গাইতেন। সে কী অপূর্ব দৃশ্য। আমরা বাবা-মার দূরদৃষ্টির কারণে শিক্ষায় সঙ্গীতে মননে ছুঁতে পেরেছি শুদ্ধতার স্পর্শ। এ শুদ্ধতার পথ ধরে চলছি আজও অবিরাম। আমাদের গ্রাম পয়ালগাছা হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে জমিদারির সম্পদ কেন দান করেন তখন বুঝিনি। আজ বুঝি গ্রামে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলোকিত পথ তৈরি করে গেছেন। খালেদা এদিব চৌধুরী আমার মেজো বোন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পয়ালগাছা হাইস্কুলে পড়ে বিড়ম্বনা নিতে না পেরে কুমিল্লা নানার বাড়িতে গিয়ে শৈলরানীতে ভর্তি হয়ে জবাব দিয়েছেন। এ বোন বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন। পয়ালগাছা হাইস্কুলের জন্য পয়ালগাছার জমিদার পরিবার অর্থাৎ চৌধুরী বাড়ি বিদ্যায়, জ্ঞানে, সংস্কৃতিতে যে অবদান রেখেছেন ইতিহাসে চিরকাল ঐতিহ্য হয়ে থাকবে। আজ পয়ালগাছা হাইস্কুল কুমিল্লা জেলার সেরা স্কুলের একটি। সেখানে মেয়েদের হোস্টেল গড়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের গৌরব হয়ে উঠেছে। আমার চাচা শামসুদ্দিন চৌধুরী, সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী, ডাঃ আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী এবং আমার ঋষি বাবা মোসলেহ্ উদ্দিন চৌধুরীকে খেলাঘরের জন্মদিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। মা-বাবা আমাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন এ বোধের আলো ঠিকরে পড়ে খেলাঘরের কর্মকা-ে। যার সঙ্গে জীবনের বন্ধন গড়ে উঠেছেÑ তাঁর হাত ধরে খেলাঘরকে আরও চেনা-জানা। খেলাঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ দিনে ইতিহাসের সত্যকে নিয়েই বর্তমানকে শেখায়। ইতিহাস ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সার্বিকভাবে গোষ্ঠীগত জাতিসত্তার স্বার্থকে মনে রেখেই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সত্যের আলোয় পথ আরও আলোকিত হয়। ইতিহাসের এ চর্চা ছাড়া কোন জাতিই এগুতে পারে না। সম্মিলিতভাবে একটি সমাজ, দেশ, প্রগতি, সত্য-সুন্দরের দিকে এগিয়ে যায়, সত্য ইতিহাসকে ধারণ করেই। খেলাঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি স্মরণ করি বাবা, চাচা ও চৌধুরী বাড়ির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। পয়ালগাছা হাইস্কুল ও চৌধুরী বাড়ির অবদানকে স্মরণে রেখে পয়ালগাছা হাইস্কুলে সংস্কৃতির আরও বড় জ্বালামুখ খুলে যাক। খেলাঘরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার হৃদয় সিক্ত হয়ে বাবা-মা এবং চৌধুরী বাড়ির চাচা ও চাচাত ভাইসহ গোটা পরিবারকে নিয়ে বাবা মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরীর সৃষ্টির প্রতিটি ধূলিকণায় শিক্ষা, সংস্কৃতি আরও বিকশিত হবে চৌধুরী বাড়ির আগামী বংশধরদের হাতে। পয়ালগাছা এখন একটি আধুনিক গ্রাম। নিজের কথা বলার জন্য নয়, বাবার কথা স্মরণ করেই সরকারের আন্তরিকতায় বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উৎসাহে পয়ালগাছা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ গড়ে তুলতে পারাটা আমার জন্য গৌরবের। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে কেন্দ্র করে ১৯৯৭ সালে ছাত্রীনিবাস, ছাত্রাবাস গড়ে তোলাও গৌরবের ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপ্রেরণা পেয়ে সংসদ সদস্য হয়ে এ কাজ করতে পারা পয়ালগাছার মানুষের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্বপ্ন দেখি সাংস্কৃতিক কর্মকা-েরও কেন্দ্র হবে পয়ালগাছায়। অসম্ভবের কিছু নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য
×