ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটে ভিন্ন ধরনের ভূমিকম্প- কিসের ইঙ্গিত?

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

সিলেটে ভিন্ন ধরনের ভূমিকম্প- কিসের ইঙ্গিত?

সালাম মশরুর সিলেট অফিস ॥ শুক্রবার রাত দশটা ৪৭মিনিটে সিলেটে ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪.১। ভূমিকম্পের পর মুহূর্তেই শুরু হয় প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি-শিলাবৃষ্টি, বাতাস ছিল উন্মাতাল। এ যাবত কালের ভূমিকম্পের চেয়ে এই কম্পন ছিল ভিন্ন ধরনের। গতানুগতিক যে কাঁপুনি (ডানে-বাঁয়ে দোলানো), হয়ে থাকে তা না হয়ে কাঁপুনিটা ছিল নিচ থেকে ওপর দিকে। আশ্চর্যজনক হলো শুধু ওই ধাক্কাটাই অনুভব করা গেছে, ঘরের ফ্যান বা আসবাবপত্র কিছুই নড়াচড়া করেনি। এছাড়া ভূকম্পনের সঙ্গে বিকট শব্দও শোনা গেছে। এই ‘অস্বাভাবিক’ ভূকম্পনের কারণ কি? আর কাঁপুনির পরপরই ভয়ঙ্কর ঝড়-বৃষ্টির পেছনে কি রহস্য আছে। এটি নতুন কোন বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করছে কিনা সেটা নিয়ে ভাবছে সচেতনমহল। বড় কোন ভূমিকম্পের আঘাত ধেয়ে আসছে কিনা, এই নিয়ে শনিবার দিনভর আলোচনা ছিল সব মহলে। ভূমিকম্পের অজানা আতঙ্ক নিয়ে কতটা ঘরে বসে থাকা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে জীবন রক্ষায় মানুষ অন্তত যতটা সুবিধা পাওয়া যায় ততটা পাওয়ার প্রত্যাশা রাখে। শুক্রবার রাতে ভূমিকম্পের পর এর মাত্রা ও উৎপত্তিস্থল জানতে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কম্পনের সময় অফিসে বিদ্যুত ছিল না, তাই ভূমিকম্প হয়েছে কিনা, তা বলা যাচ্ছে না বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আবহাওয়া অফিস থেকে ভূমিকম্প হয়েছে বলে নিশ্চিত করে বলা হয় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ে। আগারগাঁও আবহাওয়া অফিস থেকে এর দূরত্ব ছিল ২০৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হচ্ছে আবহাওয়া অফিস। যেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকার কথা। সেখানে যদি বিদ্যুতের অভাবে তাৎক্ষণিক ভূমিকম্প, ঝড় বৃষ্টি-আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি নিরূপণ ব্যাহত হয়, তাহলে আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে জানমালের নিরাপত্তা ও আগাম পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করতে আমাদের আবহাওয়া অধিদফতর কতটুকু সক্ষম? এর কারণ কি? রাতের প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও অস্বাভাবিক ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট বিমানবন্দর সড়কের লাক্কাতুরা এলাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। নবনির্মিত এ স্টেডিয়ামের বিভিন্ন স্থানের গ্লাস ভেঙ্গে পড়েছে। ফাটল দেখা দিয়েছে হসপিটালিটি বক্সে। সিলিং এবং টাইলস ছুটে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিডিয়া বক্স। ভেঙ্গে গেছে অনেক চেয়ার। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা যায়নি বলে জানিয়েছেন সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবি পরিচালক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। ঝড়ে সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে পড়েছে । সিলেট ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি কবির হোসেন জানান, ঝড়ে নগরীর মধুশহীদ এলাকায় একটি গাছ একটি বাসার ওপর উপড়ে পড়ে। বাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ওয়ার্ড মেম্বার শাকির আহমদ জানান, বাউয়ার কান্দি, বাইশটিলা এলাকায় গাছ উপড়ে পড়ে দুটি কাঁচাঘর ভেঙ্গে গেছে, তবে প্রাণহানি হয়নি। এই অঞ্চলে ঘন ঘন ভূকম্পন হচ্ছে। এর মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে আতঙ্কও বাড়ছে। নগরীতে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে অট্টালিকা, সর্বত্র বিদ্যুত লাইনের পাশাপাশি যত্রযত্র ইন্টারনেট-ডিশ-টেলিফোন লাইন, ঘন বসতি ও অপ্রশস্ত রাস্তা বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে। শহরে-নগরে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে অর্ধশতাধিক ভবন। দুর্বল কাঠামোর ভবন রয়েছে অসংখ্য। বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন যেকোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। রাজধানী ঢাকার আশপাশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে ঢাকা মহানগরীর। জোন-১-এ অবস্থিত বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্পজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। কারণ সিলেট-সুনামগঞ্জ ও ভারতের শিলংকে বিভক্ত করেছে ডাউকি নদী, আর এই ডাউকি নদী ডাউকিচ্যুতি বরাবর অবস্থান করছে, আর ভূতাত্ত্বিক চ্যুতিগুলোই বড় ধরনের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। সিলেটের সীমান্ত এলাকাবর্তী এ ধরনের চ্যুতিগুলোর কোন কোনটিতে সাব-ডাউন ফল্ট রয়েছে, যেগুলো ভূমিকম্প ঘটালে বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কারণ এতে পাথারিয়া অন্তর্চ্যুতি নিচের দিকে মোড় নিতে পারে। ভূমিকম্প নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তার গবেষণা মডেল বলছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। তিনি জানান, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা হচ্ছে পূর্বে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ী অঞ্চলে। এখানে আসলে দুটা বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। উত্তর প্রান্তে যেটা ডাউকি ফল্ট এখানে সংকোচনের হার হচ্ছে প্রতি একশ বছরে এক মিটার। গত ৫শ’ থেকে ৬শ’ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোন রেকর্ড নেই। তার মানে ৫/৬ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। এটা যদি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করা হয় তাহলে তা হবে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটানোর শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। আখতার বলেন, ঢাকার মধ্যে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো ভূতাত্ত্বিক অবস্থা না থাকলেও সিলেট এবং চট্টগ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা। ভূমিকম্প সহনীয় নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ। এ বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলছেন, ঢাকা শহরে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে চার লাখের বেশি ভবন। রাজউক এলাকায় যে সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি যার অধিকাংশই ভূমিকম্প সহনীয় নয়। ‘দুর্যোগটা শুধু আর্থকোয়েকের হ্যাজার্ডের দিক থেকে নয়। ঢাকার অবকাঠামো যেমন দুর্বল তেমনি মানুষের জনসচেতনতা কম। সেজন্য যদি একটা বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় আমাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হবে’। আনসারী বলেন, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গাও নেই ঢাকা শহরে। ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা দরকার। ইভাকুয়েশন স্পেস যদি আগে থেকে ক্রিয়েট করা না থাকে তাহলে ইভাকুয়েশন প্ল্যানটাই কোন কাজে আসবে না। সিডিএমপি যে কন্টিনজেন্সি ও ইভাকুয়েশন প্ল্যান করেছে সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে উই নিড ওপেন স্পেস। এবং সেটার জন্য এখনই সরকারি খাস জায়গাগুলো উন্মুক্ত করে ইভাকুয়েশন স্পট হিসেবে পিন পয়েন্ট করতে হবে।’ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ঢাকা মহানগরীতে বড় ভূমিকম্প ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। বুয়েটের সঙ্গে যৌথভাবে সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী সিডিএমপির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যেখানে তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ এ প্রশ্নে সিডিএমপির সাবেক ন্যাশনাল প্রজেক্ট ডিরেক্টর মুহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম বলেন ঝুঁকি কমানোর জন্য জনসচেতনা বাড়ানো দরকার। কাইয়ুম বলছেন, ভূমিকম্পের ভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে এ দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এটুকু প্রস্তুতিগুলো আছে যে কোন এলাকাটা নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী বা আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের- কে কোনটা দেখবে ফায়ার ব্রিগেড কোনটা দেখবে কী কৌশলে কাজ করবে এটা মোটামুটি কিন্তু অবহিত আছে। এখন যেটা দরকার জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা যাতে করে রিস্কটাই কমানো যায়। যাতে বিল্ডিং বানানোর সময় যেন আমরা বিল্ডিং কোড মেনে চলি, তাহলে বিল্ডিংটা নিরাপদ করা যাবে। ‘সিডিএমপির পক্ষ থেকে কিন্তু এ পর্যন্ত ৩২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল ড্রিল করছে, বিভিন্ন কলকারখানায় তা করা হয়েছে কিন্তু এটা পর্যাপ্ত নয়। তাহলে প্রস্তুত নই এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি প্রস্তত সব হয়ে গেছে এটাও ঠিক নয়। এটার ধারাবাহিকতা রাখতে এটা প্র্যাকটিসে রূপান্তর করতে হবে।
×