ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নামমাত্র শাস্তি ॥ সড়ক পরিবহন আইন ’১৭

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২২ মার্চ ২০১৭

নামমাত্র শাস্তি ॥ সড়ক পরিবহন আইন ’১৭

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রায় ৫৬ বছর পর নতুন করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭ করতে যাচ্ছে সরকার। আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী পরিবহন চালকদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু সাত বছরের বেশি সময় নিয়েও করা আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত সংগঠনের নেতা, সাধারণ মানুষের মতামত উপেক্ষিত রয়েই গেল। দুর্ঘটনার কারণে চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মাত্র তিন বছর! সড়ক দুর্ঘটনার অপরাধ হবে জামিনযোগ্য ও আপোসযোগ্য। এমন বিধান বহাল রেখেই খসড়া আইনটি আগামী সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ওঠার কথা রয়েছে। আগামী অধিবেশনে আইনটি জাতীয় সংসদে ওঠার মধ্য দিয়ে পাস করার কথা রয়েছে। এমন বাস্তবতায় আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের শাস্তি নামমাত্র থাকার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই আইন করা হচ্ছে; যেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে কোনভাবেই প্রাধাণ্য দেয়া হয়নি। যদিও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে আইনে। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা এবং এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। আগামী অধিবেশনেই তা সংসদে উত্থাপন করা হবে। নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তিনি। মন্ত্রী জানান, সংসদে উত্থাপনের প্রস্তুতি হিসেবে আইনটি আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদে উঠবে। মন্ত্রী বলেন, এই আইনটি ছিল জাতির প্রত্যাশা। ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশের ৩৪ বছর পর সড়ক পরিবহন আইনটি পাস হতে যাচ্ছে। রাস্তার জন্য যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে এ জন্য মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ ১৪৪টি স্থানে ডিভাইডার নির্মাণ ও মেরামত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’র পরিসংখ্যান মতে, দেশে প্রতিহাজার যানবাহনে নিহতের সংখ্যা বছরে ১৬৯ জন। অথচ বেশি গাড়ির দেশ জাপানে এই মৃত্যুর হার বছরে মাত্র দু’জন। শুধু ট্রাফিক নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মানার জন্য জাপানে দুর্ঘটনা অবিশ্বাস্যভাবে কম। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলাদেশে বিরাজ করছে এক নৈরাজ্যিক অবস্থা, যার কারণে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যুর সংখ্যা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইডে প্রকাশিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’ সর্বশেষ খসড়ায় উল্লেখ আছে, চালকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ সাজা হবে তিন বছর পর্যন্ত। হতাহত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা, এ নিয়েও সন্দেহ আছে। সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে গোটা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সপ্তম। আবার আন্তর্জাতিক কোন কোন সংস্থার মতে দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এমন বাস্তবতায় নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল সড়ক পরিবহন আইনে চালকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার। সকলের দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নিজেও। যার মাধ্যমে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা। কিন্তু পরিবহন শ্রমিক ও মালিকের স্বার্থ রক্ষা করেই শেষ পর্যন্ত আইন করতে যাচ্ছে সরকার। যেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সুপারিশও উপেক্ষিত থাকছে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সকলের মতামতের জন্য কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী যারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও সড়ক পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন। মূলত তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই আইনটি চূড়ান্ত করতে হচ্ছে; তা না হলে আইনে সর্বসাধারণের দাবি যুক্ত না হওয়ার কারণ ছিল না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ খসড়া আগের চেয়ে আকারে যেমন ছোট হয়েছে তেমনি কমেছে সাজা। সড়কে প্রাণহানির বিচার বিদ্যমান আইনের মতোই ১৮৬০ সালের দ-বিধি অনুযায়ী করার কথা বলা হয়েছে। আইনটির খসড়া কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতামতের জন্য কয়েক দফা বৈঠক করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আইনটি জনবান্ধব ও কার্যকর করতে অনলাইনেও মতামত নেয়া হয়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ছাড়া অন্য সবাই অন্তত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার মতামত দিয়েছিলেন। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে সড়কে প্রাণহানি ঘটালে বা কাউকে গুরুতর আহত করলে এর বিচার ১৮৬০ সালের দ-বিধির ৩০৪(খ) ধারায় করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনের সর্বশেষ এমন খসড়া প্রসঙ্গে সড়ক সচিব এম এন ছিদ্দিকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি আইনটি প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকেই চালকদের তিন বছর শাস্তির প্রস্তাব এসেছে। মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে মাত্র। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, দ-বিধি মূল আইন। তাই সড়ক আইনে এর পরিপন্থী কিছু রাখা হয়নি। তার পরও মন্ত্রিসভা কিংবা সংসদের যদি মনে হয় সাজা কমছে, তবে তারা বাড়াতে পারবে। মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, চূড়ান্ত খসড়ায় ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে প্রণীত খসড়া থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা বাদ দেয়া হয়েছে। এমনকি বাদ পড়েছে ২০১৩ সালে মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির বিভিন্ন সুপারিশ। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ২০১১ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক আইনের খসড়ায় বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সাজা ১০ বছর কারাদ- করার সুপারিশ করা হয়। পরে ওই খসড়া পর্যালোচনায় ২০১৩ সালে গঠিত কমিটির সুপারিশেও আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়। তবে সাজা কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কঠোর সাজার দাবি জানানো হলে এর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আন্দোলনে নামে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। আশির দশকে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলনে সড়কে মৃত্যুর সাজা ১৪ বছর থেকে তিন দফায় কমিয়ে তিন বছর করা হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব চন্দন কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, খসড়া আইনটি আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদে পাঠিয়েছি। গত সপ্তাহে আইনটি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উত্থাপিত হবার কথা ছিল। কোন কারণে আইনী বৈঠকে উত্থাপন হয়নি। আগামী সপ্তাহে আইনটি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উঠতে পারে বলেও জানান তিনি। আইনের খসড়ার ৫৩(১) ধারার অধীনে প্রণীত তফসিলের ৫৪(১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘বিপজ্জনক অথবা বেপরোয়াভাবে মোটরযান চালানোর কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি ঘটলে বা গুরুতর আহত হলে এ সংক্রান্ত অপরাধসমূহ দ-বিধির ১৮৬০ অনুযায়ী অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। দায়ী চালকের লাইসেন্সের ২০ পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। ১৮৬০ সালের দ-বিধি ৩০৪(খ) ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সহিত জনপথে যান বা অশ্ব চালাইয়া নরহত্যা নহে এমন মৃতু্যু ঘটায়, সেই ব্যক্তি কারাদ-ে যাহার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হইবে। এছাড়াও সড়কের ডিজাইন বা নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার দায় সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও তদারককারী সংস্থার ওপর বর্তাবে।’ তিন বছরের সাজার বিধানে হতাশা প্রকাশ করে সম্প্রতি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলেই চালকের ১৪ বছরের জেল চাই না। সড়কের কারণে কিংবা পথচারীর ভুলেও দুর্ঘটনা হতে পারে। আমাদের দাবি ছিল, চালক দায়ী হলে সে ক্ষেত্রে কঠোর সাজার বিধান রাখা, যাতে চালক শাস্তির ভয়ে হলেও যেন সতর্কভাবে গাড়ি চালান। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা পুলিশের অতিরিক্ত সুপারিনটেনডেন্ট সমমর্যাদার কর্মকর্তা দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করে দিতে পারবেন। বড় অপরাধে (তিন মাসের কারাদ-ের উর্ধে) বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে পুলিশ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আইনে সাধারণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত হলে তা খুব একটা কার্যকর হবে না। তাই আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা যেন প্রতিফলিত হয়- এ দাবি জানান তিনি। ব্লাস্ট, ব্র্যাকসহ বেসরকারী বিভিন্ন এনজিওর পক্ষ থেকেও আইনটি যুগোপযোগী করতে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেয়া হয়েছিল, যা চূড়ান্ত খসড়ায় উপেক্ষিত। প্রস্তাবিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’ যাত্রীবান্ধব করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এছাড়া পরিবহনে নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি বন্ধ করা, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করাসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ২৮ দফা দাবি জানানো হয়েছে বেসরকারী এই সংগঠনের পক্ষ থেকে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া এক স্মারকলিপিতে এসব দাবিদাওয়া উল্লেখ করা হয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির দাবিদাওয়ার মধ্যে রয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ী চালক, মালিক, যাত্রী, হেলপার, কন্ডাক্টর, সড়ক নির্মাণ প্রকৌশলী, সড়ক সুপারভিশন কর্মকর্তা, ঠিকাদার, বিলবোর্ড স্থাপনকারী, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বা অন্য যে কোন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা এবং এসব অপরাধে অপরাধীর মামলা ৩০২ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আইনের সর্বশেষ খসড়ায়ও সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আইনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দোষী চালকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। মাত্র তিন বছর শাস্তি রেখে অপরাধ জামিন ও আপোসযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে; যা মোটেও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন তিনি। চালকের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান যুক্ত করে আইনটি মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপনের দাবি জানিয়ে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চাই আইনটি সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে করা হোক। একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের চাপের মুখে বিপুলসংখ্যক মানুষ সুবিধাসঞ্চিত হবে, তা ঠিক হবে না।
×